ব্যক্তিগত কাজে গাড়ি নিয়ে বায়তুল মোকাররমের স্বর্ণ মার্কেটে এসেছেন শাহজাহানপুরের বাসিন্দা মোস্তাকিম বিল্লাহ। পার্কিংয়ে গাড়ি রাখতেই তাঁর হাতে ৫০ টাকার টোকেন ধরিয়ে দেন ইজারাদারের কর্মীরা। মোস্তাকিম বিল্লাহ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্ধারিত ফি ১০ টাকা দিতে চাইলে তাঁরা তা নিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে তিনি ৫০ টাকা দিতে বাধ্য হন। অথচ তিনি গাড়ি পার্কিংয়ে রেখেছেন মাত্র ২০ মিনিট।
এভাবে ডিএসসিসির আরও পাঁচটি গাড়ি পার্কিংয়েও অতিরিক্ত টোল আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গাড়ির মালিক–চালকদের অভিযোগ, বায়তুল মোকাররমের স্বর্ণ মার্কেটের সামনের পার্কিংয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে ৫০ টাকা আর মোটরসাইকেল থেকে ২০ টাকা করে টোল আদায় করা হয়। আর অন্য পার্কিংগুলোতে গাড়ি ও মোটরসাইকেল দুটো থেকেই আদায় করা হয় ২০ টাকা করে।
ডিএসসিসির গাড়ি পার্কিংগুলোর অবস্থান বায়তুল মোকাররমের স্বর্ণ মার্কেটের সামনে; নিউমার্কেটের ১ নম্বর ফটক (নীলক্ষেত মোড়) থেকে বটতলা ও ডাকঘর থেকে চন্দ্রিমা সুপারমার্কেট পর্যন্ত রাস্তা; নয়াপল্টনের পলওয়েল মার্কেটের সামনের রাস্তা; বাটা সিগন্যাল থেকে গাউছিয়া পর্যন্ত; মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে; দিলকুশা ২৪ তলা ভবন থেকে আলিকো ভবন পর্যন্ত রাস্তায়। গাড়ি পার্কিংগুলো ইজারা পেয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। এর মধ্যে যুবলীগসংশ্লিষ্ট ইজারাদারের সংখ্যা বেশি। গাড়িচালকদের অভিযোগ, ইজারাদারেরা ক্ষমতাসীন দলের লোক হওয়ার কারণে অতিরিক্ত টোল আদায় করলেও ডিএসসিসি তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
৫ লাখ ৩২ হাজার টাকায় বায়তুল মোকাররম মার্কেটের সামনের পার্কিং ইজারা নিয়েছেন ডি এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. দিদার। তিনি ডিএসসিসির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। সম্প্রতি দেখা যায়, মার্কেটের সামনের রাস্তায় দুই সারিতে প্রায় ৫০টি ব্যক্তিগত গাড়ি পার্ক করা। এসব গাড়িতে টোকেন বা রসিদ দিয়ে ৫০ টাকা করে টোল আদায় করছেন ডি এন্টারপ্রাইজের লোকজন। কোনো ঘণ্টার হিসাব করছেন না তাঁরা। অতিরিক্ত টোল রাখায় কয়েকজন চালককে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে।
অতিরিক্ত টোল আদায় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইজারাদার মো. দিদার বলেন, প্রতি ঘণ্টায় ১০ টাকা হারে টোল আদায়ের নিয়ম। কিন্তু অনেকেই এর চেয়ে বেশি সময় ধরে গাড়ি পার্ক করেন। তাই একসঙ্গে বেশি করে টোল রাখা হয়।
চালকেরা বলেন, অধিকাংশ গাড়ি এক ঘণ্টার মধ্যেই পার্কিং থেকে চলে যায়।
নিউমার্কেট ১ নম্বর ফটক (নীলক্ষেত মোড়) থেকে বটতলা, ডাকঘর হয়ে চন্দ্রিমা সুপারমার্কেট পর্যন্ত রাস্তায় গাড়ি পার্কিংয়ের ইজারা পেয়েছেন মেসার্স টাইমস ইন্টারন্যাশনালের মালিক ফরমান মোল্লা। তিনি ডিএসসিসির ১৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি। দেখা যায়, নীলক্ষেত মোড় থেকে বটতলা পর্যন্ত পিলখানা রোডের দুই পাশে প্রায় ৭০টি ব্যক্তিগত গাড়ি পার্ক করা। নিউমার্কেটের দক্ষিণ ফটকের পশ্চিম পাশে পার্ক করা রয়েছে শতাধিক মোটরসাইকেল। এসব যানবাহনে ২০ টাকা করে টোল আদায় করছেন প্রতিষ্ঠানের কর্মী লিয়াকত আলী। একইভাবে বটতলা, ডাকঘর ও চন্দ্রিমা সুপারমার্কেটের সামনে আরও শতাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল থেকে পার্কিং টোল নিতে দেখা গেছে।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত টোল আদায়ের কথা স্বীকার করে ইজারাদার ফরমান মোল্লা বলেন, তিনি প্রায় ১০ লাখ টাকা দিয়ে এই পার্কিং ইজারা নিয়েছেন। এর বাইরে বিভিন্ন কাজে আরও পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন ইজারার মাধ্যমে তিনি এই খরচের টাকা ওঠাচ্ছেন।
ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র জানায়, নয়াপল্টনের পলওয়েল মার্কেটের সামনের গাড়ি পার্কিং থেকে টানা দুই বছর ইজারা পেয়েছেন ১১ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব রফিকুল ইসলাম। বাটা সিগন্যাল থেকে গাউছিয়া পর্যন্ত পার্কিং ইজারা নিয়েছেন আওয়ামী লীগের নিউমার্কেট থানা কমিটির সহদপ্তর সম্পাদক শামীম চৌধুরী, সদস্য মোহাম্মদ আলী ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের দপ্তর সম্পাদক মো. ইকবাল। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে পার্কিং ইজারা নিয়েছেন ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সদস্য মো. নয়ন। এ ছাড়া দিলকুশা ২৪ তলা ভবন থেকে আলিকো ভবন পর্যন্ত রাস্তায় পার্কিং ইজারা পেয়েছেন ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক বেলাল হোসেন। সম্প্রতি এসব পার্কিংয়েও ডিএসসিসি নির্ধারিত হারের চেয়ে দ্বিগুণ টোল আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইজারাদার বলেন, পার্কিং নিতে হলে ইজারার টাকার বাইরেও ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে টাকা দিতে হয়। এ জন্য গাড়ি থেকে বেশি টোল আদায় করতে হয়। তবে ডিএসসিসির কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী টাকা নেন, তিনি তাঁদের নাম বলেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন প্রথম আলোকে বলেন, ডিএসসিসি নির্ধারিত পার্কিংয়ের টোলের বাইরে বেশি টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। ইজারার শর্ত অনুযায়ী প্রতি ঘণ্টায় ১০ টাকা করে রাখার কথা। এর বেশি রাখার প্রমাণ পেলে ইজারাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইজারাদার কোন দলের, সেটা তাঁরা বিবেচনায় নেবেন না। আর ডিএসসিসির কোনো কর্মীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।