নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের জিডির তদন্তই হয়নি
প্রায় ১১ বছর আগে পুরান ঢাকার নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১২৪ জন মারা গেলেও কোনো মামলা হয়নি। শুধু ঘটনার কথা উল্লেখ করে বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছিল। নিয়ম হচ্ছে, কোনো ঘটনায় জিডি হলে পুলিশকে তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে হয়। কিন্তু এত বছর পরও প্রতিবেদন দেয়নি পুলিশ। উল্টো জিডির নথিপত্রও এখন থানায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
নিমতলীর ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডের ৯ বছর পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে পুড়ে মারা যান ৭১ জন। এ ঘটনায় অবশ্য মামলা হয়েছে। তবে গত দুই বছরেও এ মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। কবে শেষ হবে, সেটিও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না পুলিশ।
রাসায়নিকের গুদাম থেকে ওই দুই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। নিমতলীর ঘটনার পরই পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরানোর দাবি উঠেছিল। তখন রাসায়নিক পল্লি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদন হতেই প্রায় ৯ বছর পেরিয়ে যায়। এর মধ্যেই চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনে থাকা রাসায়নিকের গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। চুড়িহাট্টার পর শিল্প মন্ত্রণালয় রাসায়নিকের কিছু গুদাম টঙ্গীর কাঁঠালদিয়া ও ঢাকার শ্যামপুরের বন্ধ হয়ে যাওয়া উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জমিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে সরানোর উদ্যোগ নেয়। সেটিও এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তবে কয়েকজন ব্যবসায়ী নিজেদের উদ্যোগে অল্প কিছু গুদাম বুড়িগঙ্গার ওপারে সরিয়ে নেন।
সবশেষ ২২ এপ্রিল দিবাগত রাতে পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় আবার রাসায়নিকের গুদামে আগুন লেগে মারা গেছেন চারজন। গুরুতর দগ্ধ হয়েছেন ২১ জন। এ ঘটনায় ২৩ এপ্রিল বংশাল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। এ মামলায় আরমানিটোলার পুড়ে যাওয়া হাজি মুসা ম্যানশন ভবনের মালিক এবং ভবনে থাকা রাসায়নিক গুদামের মালিকসহ আটজনের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে আনা হয়েছে। এ ছাড়া এজাহারে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫-২০ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
২০১০ সালের ৩ জুন রাতে পুরান ঢাকার নিমতলীর নবাব কাটরার ৪৩ নম্বর বাড়ির নিচতলায় রাসায়নিকের গুদাম থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। মুহূর্তের মধ্যে ভয়াবহ এই আগুন প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল শনিবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, ৪৩ নবাব কাটরার পাঁচতলা সেই ভবন সংস্কার করা হয়েছে, সেখানে লোকজনও থাকছেন। ওই ভবন ঘেঁষে নিহত ব্যক্তিদের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভের উল্টো দিকের দ্বিতল ভবনটিও বিধ্বস্ত হয়েছিল। ভবনটির বাসিন্দা ফরিদউদ্দিনসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়। এই ভবন সংস্কার করা হলেও এখনো কেউ সেখানে থাকেন না।
নিমতলীর বাসিন্দা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মচারী মো. এসহাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে বাড়ির নিচতলার রাসায়নিকের গুদাম থেকে আগুন লেগেছিল, সেই বাড়ির মালিক হাজি গুলজার আলী এবং তাঁর ছেলেদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদও করেনি পুলিশ। প্রথমে কিছুদিন তাঁরা এলাকায় ছিলেন না, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে তাঁরা ফিরে আসেন। তাঁদের জবাবদিহি করতে হয়নি। তিনি বলেন, নিমতলীর ঘটনায় মামলা ও বিচার হলে চুড়িহাট্টার ঘটনা ঘটত না।
চেষ্টা করেও গুলজার আলীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁর বাসার নিচতলার ফটক ভেতর থেকে আটকানো ছিল। গতকাল দুপুরে ভবনটির নিচতলায় গিয়ে বারবার কলবেল চাপার পরও কেউ দরজা খোলেননি।
পরে কথা হয় ওই গলির বাসিন্দা এসহাক ও ইসমাইলের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পরও বিচার না হওয়া দুঃখজনক।
নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের সময় বংশাল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ছিলেন আবুল হাসান। তিনি এখন গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। গতকাল বিকেলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিমতলীতে মৃত্যুর ঘটনায় হওয়া জিডির সূত্র ধরে ১২৪ জনের মরদেহ ঢাকা জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফনের জন্য স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। এরপর ওই জিডির আর তদন্ত হয়নি।
আর বংশাল থানার বর্তমান ওসি শাহীন ফকির গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সেই জিডির কপি তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। জিডির বিষয়ে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল কি না, সে তথ্য তাঁর জানা নেই।
চুড়িহাট্টার মামলার তদন্ত থেমে আছে
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনের দ্বিতীয় তলায় নকল প্রসাধন তৈরির সময় রাসায়নিক থেকে আগুন লাগে। একপর্যায়ে আগুন ওয়াহেদ ম্যানশনসহ আশপাশের পাঁচটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে পুড়ে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি অবহেলায় মৃত্যুর তথ্য তুলে ধরে চকবাজার থানায় মামলা করেন স্থানীয় বাসিন্দা মো. আসিফ আহমেদ। ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় একটি ডেকোরেটরের দোকানে ছিলেন তাঁর বাবা। তিনিও পুড়ে মারা যান।
চুড়িহাট্টার ঘটনার দুই বছর পর ওয়াহেদ ম্যানশনের রূপ বদলেছে। গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের ভেতর ও বাইরের দেয়ালে নতুন করে পলেস্তারা করা হয়েছে। নিচতলার দোকানগুলোর শাটারে নতুন রং। দোকানগুলো সংস্কার করা হয়েছে।
মামলাটি তদন্ত করছেন চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কবীর হোসেন। তিনি এ মামলার দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগুন লাগার পেছনে ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় থাকা প্রসাধনসামগ্রী এবং গুদামের মালিকসহ পাঁচ-ছয়জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এসব তথ্য যাচাই–বাছাই করে দেখা হচ্ছে।
মামলা করার বেশ কিছুদিন পর পুলিশ ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক দুই ভাই মো. হাসান ও সোহেলকে গ্রেপ্তার করে। মামলার বাদী আসিফ আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ভাগ্যের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, দুই বছর পার হয়ে গেলেও পুলিশ অভিযোগপত্র দিল না। ওয়াহেদ ম্যানশনের দুই মালিক দুই ভাইও বহু আগেই কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। এ মামলার তদন্ত নিয়ে পুলিশের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।