ক্রেতা নেই, রেস্তোরাঁ বন্ধ, কষ্টে কর্মীরা
পটুয়াখালীর জিলানি জমাদ্দার চাকরি করতেন গুলশানের ভোজনঘর নামের একটি রেস্তোরাঁয়। দুই মেয়ে, এক ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে বাড্ডা এলাকার একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। তিন দিন আগে লকডাউন শুরু হওয়ার পর ভোজনঘর বন্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎ কাজ হারিয়ে বেকার এখন জিলানি। গত লকডাউনের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি এবার ঢাকায় থাকেননি। পরিবার নিয়ে চলে গেছেন পটুয়াখালী।
স্বল্প আয়ের মানুষ জিলানি জমাদ্দারের মনে এখন রাজ্যের হতাশা। কীভাবে সংসার খরচ মেটাবেন, সেই চিন্তা তাঁকে ঘিরে ধরেছে।
কাজ হারানো জিলানি জমাদ্দার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর তো এক সপ্তাহের কথা বলে বন্ধ করছে। সেই বন্ধ তো তিন মাস পর্যন্ত ছিল। ছয় মাস অনেক কষ্ট করে চলেছি। দ্যাশে (দেশে) তো তখন যাইতে পারিনি। ঢাকা পড়েছিলাম। অনেক ধারকর্জ করে বিপদগ্রস্ত হয়ে চলছিলাম। সেই বিপদ তো এখন কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আবার লকডাউন দিচ্ছে। হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে। এখন তো আমার বড় বিপদ।’
লকডাউনে খাবার দোকান ও রেস্তোরাঁ বন্ধ করার কোনো নির্দেশনা দেয়নি সরকার। তবে রেস্তোরাঁয় বসে না খেয়ে খাবার বাসায় নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। কিন্তু ক্রেতা না থাকায় ঢাকা মহানগরের শতকরা ৮০ শতাংশ রেস্তোরাঁ বন্ধ রেখেছে মালিকপক্ষ। হঠাৎ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন দুই লাখের বেশি শ্রমিক। আর যে ২০ শতাংশ রেস্তোরাঁ খোলা আছে, তারাও ক্রেতা পাচ্ছে না। প্রতিদিনই তারা লোকসান গুনছে।
বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা খন্দকার রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার আমাদের হোটেল–রেস্তোরাঁ বন্ধ করতে বলেনি। কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে আমাদের সবার পক্ষে হোটেল–রেস্তোরাঁ চালু রাখা সম্ভব নয়। কারণ, ক্রেতা নেই। ইতিমধ্যে ঢাকা মহানগরের ৮০ শতাংশ রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। খোলা আছে ২০ শতাংশ রেস্টুরেন্ট। যারা খোলা রেখেছে, তারাও ক্রেতা পাচ্ছে না বললেই চলে।’
রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির দেওয়া তথ্য বলছে, ঢাকা মহানগরে প্রায় আট হাজার রেস্তোরাঁ রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় আছে সাড়ে চার হাজার। আর উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় আছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার। এসব রেস্তোরাঁয় সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিক কাজ করেন।
বেশির ভাগ রেস্তোরাঁ কেন বন্ধ
রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানের অন্যতম বড় হোটেলের একটি ‘রাজ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’। সেটিও দুই দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। অথচ হোটেলটিতে কাজ করতেন প্রায় ১২০ জন শ্রমিক। সবাই আপাতত কাজ হারিয়েছেন।
হোটেলটির ব্যবস্থাপক বুলবুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ভালো নেই। লকডাউনে কোনো বেচাকেনা নেই। তাই আমরা হোটেল বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। সব শ্রমিককে ছুটি দেওয়া হয়েছে। তাঁরা এখন বেকার। অনেক কষ্টে দিন পার করছেন তাঁরা। গতবারের লকডাউনে অনেক শ্রমিকের বেতন ঠিকমতো দেওয়া যায়নি। শ্রমিকেরা এখন দিশেহারা। এর মধ্যে আবার শুরু হয়েছে লকডাউন।’
কেবল গুলিস্তান নয়, রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ, কমলাপুর, মতিঝিল, ফার্মগেট, পল্টন, আরামবাগসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে অনেক রেস্তোরাঁ বন্ধ দেখা গেছে। অবশ্য এসব এলাকায় কিছু রেস্তোরাঁ খোলা রয়েছে।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের বড় রেস্তোরাঁর একটি ‘আলম রেস্তোরাঁ’। লকডাউনে রেস্তোরাঁর কার্যক্রম এক দিনও বন্ধ হয়নি। তবে রেস্তোরাঁর অর্ধেকের বেশি কর্মচারীকে ছুটি দিয়েছে মালিক কর্তৃপক্ষ। হাতে গোনা কয়েকজন কর্মচারীকে দিয়েই কার্যক্রম চালু রেখেছে তারা।
রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনায় গতবারের লকডাউনে যে সমস্যায় আমরা পড়ে গেছি, সেই সমস্যা আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আবার লকডাউন এসেছে। এখন আমরা হিমশিম খাচ্ছি। স্টাফ অর্ধেক বাদ দিয়েছি। বাকি অর্ধেক স্টাফ দিয়ে রেস্তোরাঁ খোলা রেখেছি। তবে যা বিক্রি হচ্ছে, তা দিয়ে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া কোনোভাবে সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানটি ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছে।’
লকডাউনে একই উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে তাঁদের
করোনায় প্রকোপে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটিতে অফিস, আদালতসহ জনজীবন পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়ে। বন্ধ ছিল হোটেল–রেস্তোরাঁসহ বেশির ভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। সারা দেশের হোটেল–রেস্তোরাঁর হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। করোনার প্রকোপ কমে এলে চরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন কাটানো হোটেল–রেস্তোরাঁর শ্রমিকেরা আবার কাজে ফেরেন।
এবার আবার লকডাউনে একই উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে তাঁদের। ঢাকা মহানগর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট শ্রমিক লীগের সভাপতি আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, গত তিন দিনে ঢাকায় বেশির ভাগ হোটেল–রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিয়েছে মালিকপক্ষ। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। অনেক ক্ষেত্রে বেতন না দিয়ে শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে।
তিন দিন আগে বন্ধ হয়ে গেছে ফকিরাপুলের ‘হোটেল গাউছিয়া’। হোটেলটির কর্মচারী আবুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ‘লকডাউনে হোটেল বন্ধ করে দিয়েছে মালিক। আগের লকডাউনে ছয় মাস বেকার ছিলাম। তখনো কেউ আমাদের দেখেনি। আবার লকডাউন শুরু হয়েছে। আমরা বেকার হয়ে পড়েছি। আয়ও বন্ধ হয়ে গেছে।’
হোটেল–রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, করোনায় হোটেল-রেস্তোরাঁর ব্যবসায় ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। তাঁরা সরকারি আর্থিক প্রণোদনার সুযোগ–সুবিধা পাননি।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোভিড অসুখটার যা ধরন, তাতে বেশি আক্রান্ত হয়েছে কয়েকটা সেক্টর। তার মধ্যে হোটেল ব্যবসার সেক্টরটি অন্যতম। সরকারের উচিত ছিল, এটা আগে থেকে ভাবা। এই সেক্টরের জন্য আপৎকালীন বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। এই হোটেলশ্রমিকদের জন্য বাড়তি কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে, তাদের জন্য সরকার স্পেশাল প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু সেই স্পেশাল প্যাকেজটা দিচ্ছে শুধু গ্রামে। শহরে কিন্তু দিচ্ছে না। শহরে এমন স্পেশাল প্যাকেজ চালু করা উচিত। হঠাৎ করে যারা দরিদ্র হয়ে গেল, তাদের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। হঠাৎ করে একলাফে দরিদ্র হওয়ার টার্গেট গ্রুপের মধ্যে হোটেলশ্রমিকেরা অন্যতম।’