উন্মুক্ত মাঠ মাত্র ৪২টি, সব খেলার উপযোগী নয়

লালমাটিয়া নিউ কলোনি মাঠে ফেলে রাখা হয়েছে নির্মাণসামগ্রী। নেই খেলাধুলার কোনো পরিবেশ। গত বুধবার দুপুরে তোলা।  প্রথম আলো
লালমাটিয়া নিউ কলোনি মাঠে ফেলে রাখা হয়েছে নির্মাণসামগ্রী। নেই খেলাধুলার কোনো পরিবেশ। গত বুধবার দুপুরে তোলা। প্রথম আলো

পশ্চিমে বাজার, ভাতের হোটেল, পূর্বে নির্মাণসামগ্রী। মাঝখানে মাটির স্তূপ, দক্ষিণে ভ্রাম্যমাণ দোকান—এই হচ্ছে লালমাটিয়া নিউ কলোনি ক্রীড়া চক্র মাঠের বর্তমান অবস্থা। এই অবস্থায় মাঠে খেলাধুলা দূরে থাক, নির্বিঘ্নে মাঠের এক পাশ থেকে অন্য পাশে দৌড়ানোও অসম্ভব।

শুধু এই মাঠ নয়, রাজধানীর আরও অন্তত ১৬টি মাঠের অবস্থা কমবেশি একই রকম। খেলার মাঠ নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু-কিশোরদের মানসিক-শারীরিক বিকাশ ও সুস্থ বিনোদনের জন্য খেলার মাঠ জরুরি। অথচ রাজধানীতে খেলার মাঠ, পার্ক ও উন্মুক্ত স্থানের খুবই অভাব। যেগুলো আছে সেগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণে সংশ্লিষ্টদের কঠোর হতে হবে। নতুন মাঠ তৈরিতে প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি মানুষের জন্য ৯ বর্গমিটার খোলা জায়গা (খেলার মাঠ, পার্ক ইত্যাদি) প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় জনপ্রতি খোলা জায়গার পরিমাণ এক বর্গমিটারের কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থীর গবেষণা অনুযায়ী, খোলা জায়গার সংকট সবচেয়ে বেশি পুরান ঢাকায়। ওই এলাকার আটটি ওয়ার্ডে একটুও উন্মুক্ত স্থান নেই।

‘ঢাকা শহরে বিদ্যমান খেলার মাঠের ঘাটতি ও চাহিদা পর্যালোচনা’ শীর্ষক বিআইপির গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯২টি ওয়ার্ডে (নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলো ছাড়া) সরকারি-বেসরকারি মোট ২৩৫টি খেলার মাঠ আছে। কিন্তু সব মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। সর্বসাধারণ ব্যবহার করতে পারে এমন মাঠ আছে মাত্র ৪২টি। ১৪১টি মাঠ আছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকানায়, কলোনির মাঠ আছে ২৪টি, ঈদগাহ মাঠ আছে ১২টি। ১৬টি সরকারি মাঠ বিভিন্নভাবে দখল হয়ে গেছে।

তবে গবেষণায় উল্লেখ করা সবার জন্য উন্মুক্ত মাঠের মধ্যে একাধিক মাঠ ঘুরে সেগুলো খেলার জন্য শতভাগ উপযোগী পাওয়া যায়নি।

বিআইপির গবেষণায় উন্মুক্ত মাঠের মধ্যে একটি ডিএনসিসির ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের শহীদ পার্ক খেলার মাঠ। গত বুধবার সরেজমিনে মাঠটিতে গিয়ে দেখা গেছে, এর উত্তর ও দক্ষিণ পাশে দুটি ফটক। দক্ষিণের ফটকটি বন্ধ। উত্তরের ফটক দিয়ে মাঠে লোকজন যাতায়াত করে। মাঠটি বালুচরের মতো, ঘাস নেই বললেই চলে। এর মধ্যেই কয়েকজন কিশোর ক্রিকেট খেলছে। মাঠের পশ্চিম অংশে পড়ে আছে বেশ কিছু আসবাব। স্থানীয় লোকজন জানান, প্রায় সময়ই মাঠের বিভিন্ন অংশে পড়ে থাকে আসবাবের দোকানের মালামাল। এতে খেলাধুলায় বিঘ্ন ঘটে।

অন্যদিকে লালমাটিয়া এলাকার সবচেয়ে বড় মাঠটি হচ্ছে নিউ কলোনি মাঠ। গতকাল ওই মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, এখন এটি বাজার, দোকান আর নির্মাণসামগ্রী রাখার স্থানে পরিণত হয়েছে। মাঠে কথা হয় আরশাদ হোসেন নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বলেন, মাঠটির পশ্চিম অংশে সপ্তাহে তিন দিন বাজার বসে। অন্য অংশে থাকে নির্মাণসামগ্রী। তিনি বলেন, আগে এই মাঠে নিয়মিত খেলাধুলা হতো। এখন আর সেই দিন নেই। মাঠের চারপাশের লোহার বেষ্টনীর পাশ দিয়ে হাঁটার জায়গা ছিল। স্থানীয় লোকজন সকাল–বিকেল সেখান দিয়ে হাঁটতেন। এখন হাঁটার উপায়ও নেই।

বিআইপির গবেষণা অনুযায়ী, দুই সিটি করপোরেশনের ৫৫টি ওয়ার্ডে সবার জন্য উন্মুক্ত কোনো মাঠ নেই। দখল হওয়া ১৬টি মাঠের মধ্যে ৮টি উত্তর সিটি করপোরেশনে ও ৮টি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে।
জানতে চাইলে বিআইপির সহসভাপতি নগর–পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ ফজলে রেজা বলেন, হাঁটা দূরত্বের মধ্যে প্রাথমিক ও নার্সারি স্কুল যেমন জরুরি, মাঠও তেমন জরুরি। শিশুদের মানসিক বিকাশ ও সুস্বাস্থ্যের জন্য হাঁটা দূরত্বের মধ্যে খেলার মাঠ থাকতে হবে।

বিআইপির গবেষণায় রাজধানীতে খেলার মাঠের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরার পাশাপাশি ১২টি সুপারিশও করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে একটি করে খেলার মাঠ থাকতে হবে। সে অনুযায়ী রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা করতে হবে। খেলার মাঠে যথেষ্ট পরিমাণ বসার জায়গা, খেলাধুলার সরঞ্জাম ও ছাউনি দিতে হবে। নতুন ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করতে নিরাপত্তার বিষয়ে নজর দিতে হবে। খেলার মাঠে মেলার আয়োজন বন্ধ করতে হবে। স্বল্প আয়ের মানুষ ও বস্তির শিশুদের মাঠে প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। মাঠ রক্ষণাবেক্ষণে স্থানীয় ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। যেসব এলাকায় খেলার মাঠের তীব্র সংকট, সেসব এলাকায় সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণ করে হলেও মাঠ তৈরি করতে হবে।