বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, নগরকে মধ্যবিত্ত বিলাসিতার চোখ দিয়ে দেখলে কাগুজে জীবনের ঊর্ধ্বে ওঠা যাবে না।
হোসেন জিল্লুর বলেন, মধ্যবিত্ত ধারণা হচ্ছে, ঢাকার সব স্কুলে মাঠ থাকবে, কিন্তু এটা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে মাঠকে কালেক্টিভলি (সবাই মিলেমিশে) ব্যবহারের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। একেক স্কুল একেক সময়ে মাঠ ব্যবহার করতে পারে। যাপিত জীবনের মধ্য থেকেই সমাধান খুঁজতে হবে।
‘ন্যায্য নগরজীবনের অধিকার’ শীর্ষক সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে হোসেন জিল্লুর এসব কথা বলেন। বুধবার রাজধানীর প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)। সহ-আয়োজক হিসেবে ছিল পিআইবি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), মিশন গ্রিন বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা।
ঢাকা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর উল্লেখ করে এবং জেনেভা ক্যাম্প ও টোকিওর উদাহরণ টেনে হোসেন জিল্লুর বলেন, সেখানে নগরের জায়গার সদ্ব্যবহার কীভাবে করছে, সেটা শিক্ষণীয়। নগর নিয়ে মধ্যবিত্তদের মানসিকতা কতটা সংগতিপূর্ণ, তা দেখা উচিত।
পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান আরও বলেন, ঘনত্ব মানেই সমস্যা নয়। এ শহরের ঘনত্ব মাথায় রেখে কীভাবে তা কাজে লাগানো যায়, সেটা ভাবতে হবে। শৃঙ্খলা, সমন্বিত সেবার কাঠামো তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে ঘনত্বকে ভালোভাবে ধারণ করা জরুরি। তিনি বলেন, নগর তৈরিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণপরিবহন। কিন্তু বাংলাদেশে এটা অগ্রাধিকার পায় না। কিন্তু এটা ছাড়া একটা শহর ঠিকভাবে চলে না।
হোসেন জিল্লুর বলেন, ন্যায্য নগরের জন্য কর্মসংস্থান, জনপরিসর, গণপরিবহন, ব্যয়সাধ্য আবাসনের মতো বিষয়কে স্তম্ভ ধরে এগোতে হবে। এগুলো না হলে কাগুজে শহরই থেকে যাবে।
গ্রাফিতি প্রসঙ্গে পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, এই সময়ে গ্রাফিতি মুছে ফেলা হলে বিবর্তনের মূল চিন্তার বিপরীতে যারা আছে, তারাই কিন্তু আবার চালকের আসনে বসে যাবে। গ্রাফিতি ছিল মানুষের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। এটা রক্ষা করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার থেকে এটা সংরক্ষণের সুস্পষ্ট ঘোষণা আসা দরকার। গ্রাফিতি হচ্ছে নগরের বাস্তবতা।
ধানমন্ডি ৮ নম্বরের মাঠকে শেখ পরিবারের নামে দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে উল্লেখ করে হোসেন জিল্লুর বলেন, এই দেয়ালগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। এই ডিসেম্বরের মধ্যে ভাঙা উচিত। স্বৈরাচারের শুধু দোসর নয়, তাদের কর্মচিহ্নগুলো পরিবর্তন করতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, নগরে মানুষের আবেদন নেই। এটা সব মানুষকে ধারণ করে না। নগর এখন পণ্য হয়ে গেছে। বর্তমান নগরায়ণ উল্টো দিকে হাঁটছে। ঢাকার ভুলগুলো সিলেট, চট্টগ্রামও শুরু করছে। নগরের পরিকল্পনায় সাধারণ মানুষ দূরে সরে গেছে। যে টেবিলে নগর পরিকল্পনা হয়, সেখানে মানুষ নয়, ব্যবসা থাকে। নগরকে বৈষম্যহীনভাবে গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, এবারের অভ্যুত্থানে দূর থেকে মানুষ এসেছিল ঢাকাকে মুক্ত করতে। কারণ, ঢাকা একটা কারানগরী, যে শহর সবচেয়ে বেশি অপরাধী ও ময়লা উৎপাদন করে। তিনি আরও বলেন, সংস্কারের বড় বাধা আসছে রাজনীতি থেকে। যে রাজনীতিকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, সেটা পুরোনো রাজনীতির মাধ্যমে ফিরে আসছে।
যেকোনো আন্দোলনের জন্য একটি জনপরিসর থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে ২০১৬ সালে নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন। তিনি বলেন, চারুকলার বিপরীত দিকের উদ্যান একটি বড় জায়গা ছিল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য। কিন্তু বিগত সরকার সেসব জনপরিসরের জায়গাগুলো কমিয়ে এনেছিল।
সামান্তা শারমিন আরও বলেন, ৫ আগস্টের আগে লুকিয়ে করা গ্রাফিতি ৫ আগস্টের পর মুছে সুন্দর গ্রাফিতির নামে অভ্যুত্থানের স্পিরিট ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এটাকে রাজনৈতিক ও দার্শনিক দিক থেকে মোকাবিলা করতে হবে।
আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজের সভাপতিত্বে সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন সাংবাদিক মং সিং হাই মারমা, ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকসের পলিসি অ্যানালিস্ট মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, অধ্যাপক তানজিল শফিক ও ইফাদুল হক।