ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল চালু হয় ১৯৬৭ সালে। হলটির অবয়বে বয়সের ছাপ পড়েছে। এখানে-সেখানে প্রায়ই পলেস্তারা খসে পড়ে। সিলিং ফ্যান খুলে পড়ার ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। কিন্তু আবাসিক এই হলের সংস্কার বা পুনর্নির্মাণে বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ নেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। ফলে সহস্রাধিক ছাত্র হলটিতে বসবাস করছেন ঝুঁকি নিয়ে। সর্বশেষ আজ শনিবার সকালে ভূমিকম্পে হলভবন কেঁপে উঠলে আতঙ্কিত হয়ে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন এক ছাত্র। এ অবস্থায় ঝুঁকির বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মুহসীন হলের ৩৯৫টি কক্ষে বর্তমানে ১ হাজার ২৬৬ জন ছাত্র অবস্থান করছেন। তবে শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, এই হিসাবের বাইরেও অনেক অনাবাসী ছাত্র ও অছাত্র হলে থাকছেন। ফলে হলটিতে বসবাসকারীর সংখ্যা প্রকাশিত সংখ্যার দ্বিগুণের কাছাকাছি বলছেন হলের শিক্ষার্থীরা।
শনিবার সকালে ঢাকাসহ সারা দেশে ভূকম্পন অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার এই ভূমিকম্পে অনেক মানুষ ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। অনেকে আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করেন। সে রকম পরিস্থিতি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও। মাস্টারদা সূর্য সেন হলের এক ছাত্র হলের দোতলার একটি কক্ষ থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হন। আরও কয়েকটি হলে আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে গিয়ে কিছু শিক্ষার্থী পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছেন।
ভূমিকম্পে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের অন্তত সাতটি কক্ষসহ বিভিন্ন স্থানের পলেস্তারা খসে পড়ে। হলের পাঠকক্ষের দরজার কাচ ভেঙে যায়। এ সময় তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে এক ছাত্র আহত হন।
মুহসীন হলের প্রাধ্যক্ষ মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে আরও বলেন, ‘আমার হলের এক ছাত্র ভূমিকম্প-আতঙ্কে তৃতীয় তলা থেকে লাফ দিয়েছেন। তিনি তিনতলাসংলগ্ন দোতলার ছাদের ওপর পড়েছিলেন। তাঁকে উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। তিনি গুরুতর আহত হননি। আতঙ্কে পাঠকক্ষ থেকে ছাত্ররা বের হওয়ার সময় হুড়োহুড়িতে দরজার কাচ ভেঙে যায়। সেখানে কিছু ছাত্র আঘাত পেয়েছেন।’
এর আগে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে মুহসীন হলের পত্রিকাকক্ষের বৈদ্যুতিক পাখা খুলে পড়ে। এ সময় ওই কক্ষে একজন শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি অল্পের জন্য রক্ষা পান।
প্রায়ই মুহসীন হলে পলেস্তারা খসে পড়ে। হলের কক্ষসহ বিভিন্ন স্থানে দেয়াল ও মেঝেতে ফাটলও রয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে হলটির অন্তত তিনটি স্থানে বড় অংশের পলেস্তারা খসে পড়ে। প্রতিটি ঘটনায় শিক্ষার্থীরা অল্পের জন্য রক্ষা পান। এর মধ্যে ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর হলটির ১০৬ নম্বর কক্ষের সিলিং থেকে অন্তত ১৫ কেজি ওজনের একটি পলেস্তারা খসে পড়ে।
১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের একটি ভবনের ছাদ ধসে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৩৯ জন ছাত্র, কর্মচারী ও অতিথি প্রাণ হারান। দিনটি প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শোক দিবস হিসেবে পালন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
মুহসীন হলের একাধিক শিক্ষার্থী তাঁদের হলেও এ ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। অন্তত দুজন ছাত্র প্রথম আলোকে বলেছেন, জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডির মতো কোনো ঘটনা তাঁরা দেখতে চান না। মুহসীন হলের দুরবস্থা নিয়ে আশ্বাসের পর আশ্বাস দেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তাঁদের দাবি, অবিলম্বে মুহসীন হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের জায়গায় নতুন ভবন নির্মাণ করা হোক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দু-তিনজন ছাত্র জানালেন, গত চার-পাঁচ বছরে মুহসীন হলে বড় পরিসরে কোনো সংস্কারকাজ হয়নি। এই সময়ে হলে টুকটাক (খুবই ছোট পরিসরে) সংস্কারকাজ এবং দেয়ালে রং করা হয়েছে।
জানতে চাইলে মুহসীন হলের প্রাধ্যক্ষ মাসুদুর রহমান বলেন, ‘কোনো ঘটনা ঘটলেই তার সমাধান করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানানো হয়। ভূমিকম্পের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীরা মুহসীন হল পরিদর্শন করেছেন, আমরা তৎপর আছি। আমরা চাই না কোনো শিক্ষার্থীর জীবন ঝুঁকিতে থাকুক।’
মাসুদুর রহমান আরও বলেন, হলের কিছু কক্ষের পলেস্তারা আগেও খসে পড়েছে। আজকেও দু–এক জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। গত বছর হলের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলা সংস্কার করা হয়েছে। আরও তিনটি তলা সংস্কারের দরপত্র প্রক্রিয়া চলমান। শিগগিরই কাজ শুরু হবে।
আজকের ভূমিকম্পের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীরা হলটি পরিদর্শন করেছেন জানিয়ে মুহসীন হলের প্রাধ্যক্ষ বলেন, ‘রোববার আমরা হলের বিষয়ে আবার বসব।’