ধার করা টাকা নিয়ে টিসিবির লাইনে
রাজধানীর লালমাটিয়ায় ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পরিবেশকের দোকানে ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য কিনতে এসেছিলেন গৃহবধূ শম্পা মধু। গতকাল সোমবার দুপুর ১২টার দিকে টিসিবির পরিবেশকের দোকানটিতে গিয়ে দেখা যায়, শ দেড়েক মানুষের সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন শম্পা।
জানতে চাইলে শম্পা বলেন, টিসিবির ভর্তুকি মূল্যের পণ্য কেনার মতো টাকাও তাঁর কাছে ছিল না। এক ব্যক্তির কাছ থেকে অনেক অনুরোধ করে ৫০০ টাকা ধার নিয়ে পণ্যগুলো কিনতে এসেছেন।
শম্পার স্বামী প্রশান্ত মধু একজন বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি। দিনে যা কাজ করতে পারেন, তার বিপরীতে মজুরি পান। তাই দিয়ে চলে চার সদস্যের সংসার। তিনি বলেন, স্বামী পায়ে আঘাত পেয়েছেন। দুই সপ্তাহ ধরে কাজ করতে পারেন না। সংসারে আগেও টানাটানি ছিল। এখন কোনোভাবেই চালাতে পারছেন না।
শম্পা মধু সেই সব মানুষের একজন, যাঁরা এখন ঋণ করে খাবার কিনছেন। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) গত বৃহস্পতিবার এক জরিপে জানিয়েছে, বিগত ছয় মাসের মধ্যে মানুষের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। এরপর রয়েছে রোগ ও চিকিৎসা ব্যয়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও পরিবহন ব্যয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ৬৮ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাঁরা খাবার কিনতেই এখন হিমশিম খাচ্ছেন। গত আগস্ট মাসের তথ্য বলছে, ওই মাসে খাবার কিনতে ঋণ নিয়েছেন ৬৪ শতাংশ মানুষ।
শম্পার পরিবারে দুটি বড় ধাক্কা একসঙ্গে এসেছে। একটি হলো একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অসুস্থতা। অন্যটি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। কথা বলতে বলতে শম্পার গলা ভারী হয়ে আসে। একসময় কেঁদেও ফেলেন। তিনি বলেন, স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর চিকিৎসা তো দূরের কথা, দুই সন্তানের মুখে খাবার দেওয়াটাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাঁর ভাষ্য, গত রোববার বাসার বাজার শেষ হয়ে যায়। টাকা ছিল না, তাই কিছু কিনতেও পারেননি। দুই সন্তানসহ রাতে না খেয়ে থাকতে হবে শুনে তাঁর বোন ভাত ও তরকারি রান্না করে পাঠিয়েছেন।
শম্পা আরও বলেন, মা আর বোনের সহযোগিতা তিনি পাচ্ছেন। তবে তাঁরা আর কত করবেন? তাঁর ১১ বছর বয়সী বড় ছেলে স্কুলে যায়। তাকে টিফিন না দিলে বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারে না। ছোট মেয়েকে তিন হাজার টাকা ঋণ করে স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। এই টাকা এখনো শোধ করতে পারেননি।
টিসিবি পরিবার কার্ডের (ফ্যামিলি কার্ড) মাধ্যমে গতকাল ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি শুরু করেছে। এর আওতায় কার্ডধারীরা মাসে একবার দুই লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি মসুর ডাল, এক কেজি চিনি ও দুই কেজি পেঁয়াজ কিনতে পারেন। এই ‘প্যাকেজে’র দাম ৪৪৫ টাকা। বাজার থেকে একই পণ্য কিনতে প্রায় ৮৫০ টাকা লাগে।
লালমাটিয়ায় যাঁরা টিসিবির দোকানে পণ্য কেনার সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের অন্তত ১২ জনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের বেশির ভাগ বলেছেন, টিসিবির পণ্য সাশ্রয়ী। তবে মাসে একবার যে পরিমাণ পণ্য দেওয়া হয়, তাতে তাঁদের প্রয়োজন মেটে না। বাইরে থেকেও কিনতে হয়। আর বাজারে শুধু তেল, চিনি, ডাল নয়; চাল, সবজি, মাছ, ডিম, মাংসসহ সব পণ্যের দামই বাড়তি। এক আঁটি লালশাকের দামও এখন ১৫ টাকা। যদিও আঁটি ছোট হয়েছে। এতে এক বেলার শাক কিনতেই লাগছে ৪৫ টাকা।
টিসিবির সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা গৃহিণী মনোয়ারা বেগম বলছিলেন, নানাভাবে সংসারের ব্যয় কমাতে হচ্ছে তাঁকে। শুরুতেই বাদ পড়েছে মাছ, মাংসের মতো পুষ্টিকর খাবার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে প্রতি শুক্রবার একটি করে ব্রয়লার মুরগি কিনে আনতাম। সবাই মিলে ভাত আর মুরগির মাংস খেতাম। এখন আর তা পারি না।’
মনোয়ারার পরিবারে সাত সদস্য। তিনি, স্বামী, ছেলে, ছেলের বউ ও তিন নাতি-নাতনি। উপার্জনকারী দুজন—তাঁর স্বামী ও ছেলে। দুজনের আয় মাসে ২৬ হাজার টাকা।
মনোয়ারা জানান, বাসাভাড়া বাবদই ব্যয় হয় ১১ হাজার টাকা। বাকি টাকায় সাতজনের খাবার, ওষুধ, দুই নাতির পড়াশোনা ও অন্যান্য খরচ। স্বামী দুটি ভবনে প্রতিদিন ঝাড়ু দিয়ে মাসে ১০ হাজার টাকা পান। আর ছেলে গাড়ি চালিয়ে পান ১৬ হাজার টাকা। এক বছরে এই দুজনের আয় এক টাকাও বাড়েনি।
চট্টগ্রামে গতকাল টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে তা হয়নি। ফলে পরিবার কার্ডধারীরা পণ্য কিনতে পারেননি। অবশ্য যাঁদের কার্ড নেই, তাঁদের বাজার থেকেই চড়া দামে নিত্যপণ্য কিনতে হয়। দেশের এক কোটি পরিবারকে পরিবার কার্ড দেওয়ার কথা বলছে সরকার। অবশ্য অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, অন্তত দুই কোটি পরিবার এখন সংকটে আছে। আর মূল্যস্ফীতির কারণে চাপে পড়েছে মধ্যবিত্তরাও।
চট্টগ্রাম শহরের আলীনগর এলাকার বাসিন্দা শামসুন নাহার টিসিবির কার্ড না পাওয়াদের একজন। বয়স তাঁর পঞ্চাশের কাছাকাছি। স্বামী মারা গেছেন বছর দশেক আগে। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে বেকার। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
শামসুন নাহার জানান, তিনি কয়েকটি বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে সংসার চালান। আয় মাসে আট হাজার টাকার মতো। এর মধ্যে বাসাভাড়া দিতে হয় চার হাজার টাকা। বাকি টাকায় খাবার কেনা ও অন্য ব্যয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে প্রায় সব পণ্যের দামই বাড়তি। আগে যে সাবান ৩০ টাকায় কেনা যেত, সেটি এখন ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। চাল, ডালের দাম আগেই বেড়েছে।
বাড়তি ব্যয় কীভাবে সামাল দিচ্ছেন জানতে চাইলে শামসুন নাহার বলেন, ‘মানুষের কাজে যাওয়ার ফাঁকে দোকানে চা-রুটি খেতাম। এখন খাই না।’
উল্লেখ্য, এক বছরে ময়দার দাম ৪২ শতাংশ বাড়ায় বেকারির মালিকেরা চায়ের দোকানে বিক্রি হওয়া বানরুটির দাম বাড়িয়ে ১৫ টাকা করেছেন, আগে ছিল ১০ টাকা।