পুরান ঢাকার পুরাকীর্তিগুলো কি হারিয়ে যাবে
মূল ফটকের দুই পাশে ময়লা ফেলার স্থান। বড় পিলারের সামনে আবর্জনায় চাপা পড়ে গেছে সাদা শঙ্খের নকশা। বাড়ি ভেঙে ও সংস্কার করে থাকছে বেশ কয়েকটি পরিবার। বাড়ির ভেতরে আছে কারখানা, অফিস। অথচ পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত স্থাপনাটি সংরক্ষণ করার কথা সরকারের।
পুরান ঢাকার ওয়ারীর টিপু সুলতান রোডের শতবর্ষী এ স্থাপনার নাম শঙ্খনিধি হাউস। চার দশক আগে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত হয় স্থাপনাটি। নিয়ম অনুযায়ী, সংরক্ষণের কথা থাকলেও ভবনটি ভাঙার কাজ চলছে। সবশেষ ২০১১ সালে ভবনের একাংশ ও ছাদ ভাঙেন দখলদারেরা।
শঙ্খনিধি হাউসের মতো শতবর্ষী অনেকগুলো স্থাপনা রয়েছে পুরান ঢাকায়। দেশের পুরাতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এসব স্থাপনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। তবে দখল, অপরিকল্পিত ব্যবহার ও সংস্কারের অভাবে হারাচ্ছে এ ঐতিহ্য। নিদর্শন চিহ্নিত করতেই যাচ্ছে বছরের পর বছর।
সম্প্রতি পুরান ঢাকার অন্তত ২৫টি শতবর্ষী ভবন ঘুরে দেখা যায়, ঐতিহাসিক এসব স্থাপনার অনেকগুলো গুদাম ও কারখানা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। কোনোটিতে রয়েছে ৩০টির বেশি পরিবার। সংরক্ষিত হিসেবে তালিকাভুক্তির পরও ঘটছে ভবন ভাঙার ঘটনা।
স্থাপনা নিয়ে কাজ করে আরবান স্টাডি গ্রুপ নামের একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান। তারা ২ হাজার ২০০টি বাড়িকে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ উল্লেখ করে উচ্চ আদালতে রিট করেছিল। এসব বাড়ি অক্ষত রেখে সেগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য নির্ণয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে ২০১৮ সালে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। মাঠপর্যায়ে জরিপ করে সেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাঁচ বছরেও দাখিল করতে পারেনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
সংরক্ষণে নেই উদ্যোগ
২০০৯ সালে পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারসহ চারটি অঞ্চল ও মোট ৯৩টি স্থাপনাকে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। বিধি অনুযায়ী, এসব স্থাপনা ও এসব এলাকায় অবস্থিত ইমারত, উন্মুক্ত জায়গা, রাস্তা ও গলির প্রকৃত অবস্থার পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংস্কার, অপসারণ ও ধ্বংসের ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়।
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এসব ভবনের সংস্কার করে কাঠামো বদলে দেওয়া হচ্ছে। স্থাপনাগুলো সংরক্ষণে নীতিমালার কোনো প্রয়োগ নেই। অপর দিকে তা বর্তমান ব্যবহারকারীদের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।
শঙ্খনিধি হাউসের নিচতলায় আছে মোটর সারাই কারখানা। ছাদে হয়েছে নতুন ঘর। পুরোনো নকশা মুছে লাগানো হয়েছে টাইলস। ইতিহাস ও স্থাপত্যশৈলী বিবেচনায় বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে শঙ্খনিধি হাউস। তবে শতবর্ষী এই স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেই।
শঙ্খনিধি হাউসের মতোই অবস্থা রাজধানীর অন্যতম পুরোনো অধ্যায়ের গল্প ‘রূপলাল হাউসের’। ফরাশগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর কোলঘেঁষা ২০০ বছরের পুরোনো এই স্থাপনাটিও তালিকাভুক্ত প্রত্নতত্ত্ব।
রূপলাল হাউসে এখনো ৩০টির বেশি পরিবার বাস করছে। আছে মসলার গুদাম। বাসিন্দারা ইচ্ছেমতো ভবন সংস্কার করছেন। টিনের বেড়া, নতুন ইট ব্যবহারে বদলে যাচ্ছে বাড়ির মূল নকশা।
মুনতাসীর মামুনের ‘পুরানো ঢাকা: উৎসব ও ঘরবাড়ি’ বইয়ে রূপলাল হাউসের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকায় ১৮৪০ সালের আগে নির্মিত ঘরবাড়ির যে কটি এখনো টিকে আছে, এর একটি আর্মেনী জমিদার আরাতুনের বাড়ি, যা আমাদের কাছে রূপলাল হাউস নামে পরিচিত।’
তবে ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হলেও এসব স্থাপনার সুরক্ষা ও সংরক্ষণে পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন মাঠপর্যায়ের জরিপ কাজের তদারকি করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তালিকায় থাকা প্রায় সব স্থাপনায় জরিপ করার কাজ শেষ হয়েছে। মোট সংখ্যাটা ৫০ হতে পারে। চূড়ান্ত সংখ্যা আমরা অধিদপ্তরে বৈঠক করে জানাব।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বললেন, সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া বাসিন্দাদের বরাদ্দ বাতিল বা উচ্ছেদ অধিদপ্তরের পক্ষে সম্ভব নয়। তালিকাহীন বাড়ি বহুবর্ষী হলেও সেগুলো সংস্কার করতে অধিদপ্তর আইনগতভাবে বাধা দিতে পারে না।
ভাঙা হচ্ছে শতবর্ষী ভবন, ইচ্ছেমতো পরিবর্তন
কোর্ট হাউস স্ট্রিটের শতবর্ষী ভবন নিলাম ঘর। খাজনা দিতে না পারলে মানুষের সম্পদ এখানে নিলামে তুলতেন ব্রিটিশ শাসকেরা। পাকিস্তান আমলেও ছিল এই প্রচলন। একসময় এটি ছিল ঢাকার জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে। গত বছর হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে ভবনটি ভাঙা হয়।
আরবান স্টাডি গ্রুপ বলছে, ইজারা নিয়ে ২০২২ সালে এখানে বহুতল ভবন নির্মাণ শুরু করে ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশন। এখন সেখানে শতবর্ষী সেই নিলাম ঘরের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায় না।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উনিশ শতকে ঢাকার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে মোহিনী মোহন দাস ছিলেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব। পুরান ঢাকার হেমেন্দ্র দাস রোডে ছিল তাঁদের পারিবারিক একটি বাড়ি। শতবর্ষী এই বাড়িও ২০২১ সালের জুন মাসে ভেঙে ফেলা হয়েছে।
লাল মোহন সাহা স্ট্রিটের ২২৭ নম্বর বাড়িটির দেয়ালে এখনো মোগল স্থাপত্যশৈলীর চিহ্ন আছে। তবে বাড়িটি কবে নির্মিত, তা জানা যায় না। বাড়ির বর্তমান মালিক সাকিলা খাতুন বললেন, ছাদ ঝুঁকিপূর্ণ। চুন-সুরকি খুলে গুঁড়া হয়ে পড়ছিল। বাসযোগ্য করতে সংস্কার করা ছাড়া উপায় ছিল না।
সংস্কারের সময় অলংকরণ মুছে ফেলার উদাহরণ কম নয়। লাল মোহন সাহা স্ট্রিটের ২২৪ নম্বর বাড়ির সামনের দিকের ইন্দো-ইউরোপীয় রীতির সব অলংকরণ মুছে সম্প্রতি প্লাস্টার করা হয়েছে। একই অবস্থা বি কে দাস লেনে লক্ষ্মী ভিলা ও পূর্ণ চন্দ্র ব্যানার্জি রোডের ৬ থেকে ১০ নম্বর বাড়ির।
বি কে দাস লেনের মঙ্গলালয়ের ছাদে বাঁ দিকের ১৯১৫ নির্মাণ সময়কাল লেখা তোরণটি সম্প্রতি ভাঙা হয়। দোতলার সামনের দিকের বারান্দার দেয়ালও আটকে দেওয়া হয়েছে ইটের গাঁথুনিতে।
ইতিহাসবিদ ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল আর্কাইভের সাবেক পরিচালক শরীফ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সব উন্নত দেশে প্রত্নতত্ত্ব রক্ষার দায়িত্ব নেয় সরকার। প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ দিয়ে এই কাজ করতে হবে। সব স্থাপনা প্রত্নতত্ত্ব না-ও হতে পারে। আগে সংখ্যা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
আছে বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি
রূপলাল হাউস থেকে বেরিয়ে ডানে বি কে দাস লেনের দুই পাশে রয়েছে পুরোনো অনেক বাড়ি। ধ্বংসের মধ্যেও স্থাপত্যের কৌলীন্য ধরে রেখেছে এর মধ্যে একটি বাড়ি। বাড়িটির নাম ‘বড় বাড়ি’।
১৯১০ সালের আগে নির্মিত এই বাড়ির সামনের অংশের ওপরে উঠে দেখা গেল, মেঝেতে বিশ্রাম নিচ্ছেন ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক। কোথাও কোথাও বেরিয়ে আছে ছাদ ও দেয়ালের প্লাস্টার। কাঠামো ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা দুটোই সঙিন। শিশু, বৃদ্ধ নিয়ে শতবর্ষী বাড়িটিতে বসবাস করেন অনেক মানুষ। তাঁদের অধিকাংশ এই বাড়িতে থাকা আসবাব তৈরির কারখানার শ্রমিক।
বাড়িটি থেকে আর কয়েক গলি পার হলেই ‘শহীদ শামসুল আলম ছাত্রাবাস’। পুরোনো এই ভবনের সংস্কার করা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে কিছুদিন আগে। বাড়িটির বৈশিষ্ট্য এর নির্মাণকাল বলে দেয়। প্রথমতলা মোগল, দ্বিতীয়টি ব্রিটিশ ও তৃতীয় তলা পাকিস্তান আমলে নির্মিত।
তৃতীয় তলার বাসিন্দা জয়ব্রত সরকার জানালেন, ছাদলাগোয়া দেয়ালে এসেছে চুন-সুরকির আদি রূপ। ভবনটির একাংশে ১২ থেকে ১৩টি পরিবার বসবাস করে। নিচতলা ভাগ হতে হতে বদলেছে মূল স্থাপত্যের কাঠামো। ঝুঁকি নিয়ে থাকছেন বাসিন্দারা। যখন–তখন ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।
একই রকম ঝুঁকিপূর্ণ শাঁখারীবাজারের পুরোনো অনেক বাড়ি। এ গলির প্রবেশমুখে হাতের বাঁ দিকে ১০৫ নম্বর ভবনটি কত আগে নির্মিত, সেটা কেউই বলতে পারলেন না। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এ ভবনে কতজন বাস করেন, কেউ তথ্য দিলেন না। ভেতর থেকে শোনা গেল বহু মানুষের কণ্ঠস্বর।
সম্প্রতি ঢাকায় একাধিকবার ভূমিকম্প হয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলে আসছেন, ঢাকায় ৭ মাত্রার চেয়ে বড় ভূমিকম্প হলে এসব ভবন মুহূর্তে ধসে পড়বে। ভূমিকম্প ছাড়াও যেকোনো সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই ঝুঁকি নিরসনে সবার আগে পুরোনো স্থাপনা চিহ্নিত করা দরকার।
আরবান স্টাডির প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, অধিদপ্তর এত বছরেও প্রতিবেদন না দেওয়ায় সংকটের সমাধান হয়নি। ঐতিহাসিক এসব স্থাপনা নষ্ট হওয়াও থেমে নেই। এর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন বহু বাড়ি ভাঙা হয়েছে, যেগুলো তালিকাভুক্ত হতে পারত।