মিরপুরে শ্রমিক বিক্ষোভ দমনে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যুবলীগ নেতা

দিনভর পোশাককর্মীরা সড়কে অবস্থান নিলেও তাঁদের শান্ত করতে পুলিশ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। দূরে দাঁড়িয়ে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছে পুলিশ।

ঢাকার মিরপুরের পল্লবী এলাকায় তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ শুরু করলে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে নামেন স্থানীয় যুবলীগের নেতারা। এ সময় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যুবলীগ নেতা আওলাদ হোসেন
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার মিরপুরের পল্লবী এলাকায় বিক্ষোভরত পোশাকশ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে মাঠে নেমেছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তাঁদের মধ্যে আওলাদ হোসেন ওরফে লাক্কু নামের যুবলীগের এক নেতাকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আওলাদ ওই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে কয়েকটি গুলিও ছুড়েছেন। তবে তাঁর ছোড়া গুলি কারও শরীরে বিদ্ধ হয়েছে কি না, তা জানা যায়নি।

আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে পল্লবীর অ্যাপোলো নিটওয়্যার নামের একটি কারখানার সামনে এ ঘটনা ঘটে। তবে এর পরেও মিরপুর অঞ্চলের বিভিন্ন পোশাক কারখানার বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা দিনভর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। সন্ধ্যা সাতটায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁরা সড়কে ছিলেন।

দুর্বৃত্তরা পোশাকশ্রমিকদের ওপর হামলা চালায়
ছবি: খালেদ সরকার

স্থানীয় লোকজন জানান, আওলাদ হোসেন স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। তিনি মিরপুর অঞ্চলের বিভিন্ন পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। আওলাদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আওলাদ হোসেন তাঁদের কমিটিতে সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে আছেন। তবে তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেন না। তাঁকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। কারণ, সে সন্ত্রাসী ও খারাপ লোক এবং ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি করেন।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, আওলাদ হোসেন আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে কয়েকটি গুলি ছুড়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওলাদ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সকালে পোশাককর্মীদের সঙ্গে যখন ঝামেলা হয়, তখন তিনি ঘটনাস্থলেই ছিলেন না। তিনি অফিসে ছিলেন। তবে তাঁর লাইসেন্স করা একটি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে স্বীকার করে আওলাদ হোসেন বলেন, সেই অস্ত্র তিনি এভাবে জনসমক্ষে বের করতে পারেন না।

হামলার প্রতিবাদে পোশাকশ্রমিকেরাও পাল্টা হামলা চালান
ছবি: খালেদ সরকার

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, পোশাক কারখানার কর্মীদের ওপর গুলি ছোড়া হয়েছে, এমন কোনো তথ্য তিনি জানেন না। পোশাক কর্মীদের ওপর কারা হামলা করেছে, সেই তথ্যও তাঁর জানা নেই।

ঘটনার শুরু যেভাবে

পোশাককর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার সূত্রপাত হয় পল্লবীতে ইপিলিয়ন গ্রুপের একটি পোশাক কারখানার কর্মীদের আটকে রাখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। অন্য একটি কারখানার শ্রমিকদের আন্দোলনে ইপিলিয়নের কর্মীরা যুক্ত হতে পারেন—এমন আশঙ্কা থেকে তাঁদের কারখানা থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছিল না। কারখানার আশপাশ এলাকায় লাঠিসোঁটা নিয়ে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী একাধিক ব্যক্তির অনুসারীরা শ্রমিকদের ভয় দেখাচ্ছিলেন। এ নিয়ে ইপিলিয়নের কর্মীরা তাঁদের সঙ্গে প্রথমে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এর জেরে পোশাককর্মীদের ওপর তাঁরা হামলা করেন।

একপর্যায়ে আশপাশের কয়েকটি পোশাক কারখানা থেকে শ্রমিকেরা সড়কে নেমে আসেন
ছবি: খালেদ সরকার

ইপিলিয়ন গ্রুপের কর্মী ও শ্রমিক প্রতিনিধি সুমাইয়া আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মিরপুরের একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের বেতন–ভাতা বাড়ানোর দাবিতে অনেক দিন ধরে আন্দোলন চলছিল। গতকাল সোমবার তাঁরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। এ কারণে গতকাল ইপিলিয়ন কারখানার কর্মীদের সকালেই ছুটি হয়ে যায়। কর্মীরা যেন রাস্তায় যেতে না পারেন, এ জন্য আজ সকাল নয়টার দিকে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম চৌধুরীর (বাপ্পী) অনুসারী ২০-২৫ জন কর্মী কারখানার আশপাশে অবস্থান নেন। তাঁরা শ্রমিকদের ভয় দেখানো শুরু করেন। বিষয়টি ইপিলিয়ন কারখানা কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে তাঁরা বহিরাগত ব্যক্তিদের পক্ষে অবস্থান নেয়।

পোশাকশ্রমিকদের ওপর দুর্বৃত্তরা পাল্টা হামলা করে
ছবি: খালেদ সরকার

সুমাইয়া আক্তার বলেন, শুরুতে বহিরাগত ব্যক্তিরা কারখানার শ্রমিকদের ভয় দেখাচ্ছিলেন। পরে এ নিয়ে কথা বলতে গেলে তারা পোশাককর্মীদের ওপর হামলা করেন। অনেক নারী কর্মীকে পিটিয়ে আহত করেন। এমনকি ইপিলিয়ন নিটওয়্যার কারখানার ভেতরের ক্যানটিনে ঢুকেও নারী কর্মীদেরও মারধর করা হয়।

কারখানার ক্যানটিনে মারধরের শিকার হয়েছেন দাবি করে রিয়া আক্তার নামের এক পোশাকশ্রমিক জানান, তিনি তখন ক্যানটিনে খাচ্ছিলেন। কয়েকজন সেখানে ঢুকে তাঁদের মারধর শুরু করেন। বাইরে কোনো আন্দোলনে যুক্ত না হওয়ার জন্য হুমকি দেন।

এ ঘটনার পর ইপিলিয়নের কর্মীরা সকাল নয়টার দিকে সড়কে নেমে পড়েন। এর মধ্যে হামলায় তিন শ্রমিক নিহত হওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়ে। পরে তাঁদের সঙ্গে মিরপুর অঞ্চলের আরও কয়েকটি কারখানার শ্রমিকেরা সড়কে অবস্থান নেন। তাঁদের প্রতিহত করতে স্থানীয় প্রভাবশালী একাধিক ব্যক্তির লোকজন আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে মাঠে নামেন। তাঁদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পোশাককর্মীদেরও লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় অবস্থান করতে দেখা যায়।

দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার সময় চেয়ার ভাঙচুর করা হয়
ছবি: খালেদ সরকার

একাধিক পোশাককর্মীর ভাষ্য, ইপিলিয়ন কর্তৃপক্ষ কারখানার শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে বিভিন্ন সময় স্থানীয় কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে বাপ্পীর কর্মীদের দিয়ে ভয় দেখান। এই অভিযোগের বিষয়ে ইপিলিয়ন নিটওয়্যার কারখানায় গিয়ে সংশ্লিষ্ট কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। কারখানার ভেতরে ঢুকে কথা বলতে চাইলে নিরাপত্তা কর্মীরা এই প্রতিবেদককে কারখানার ভেতরে প্রবেশ করতে দেননি। অভিযোগের বিষয়ে জানতে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম বাপ্পীর মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন

পোশাককর্মীদের ওপর হামলা এবং দিনভর সড়ক অবরোধ করলেও পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁদের শান্ত করার উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, বিএনপির অবরোধ কর্মসূচির কারণে এই সড়কে যান চলাচল অনেক কম ছিল। এই সড়কে আসা যানবাহন বিকল্প সড়ক ব্যবহার করেছে। এতে কোনো যানজট হয়নি। এ কারণে শ্রমিকদের শান্ত করতে পুলিশ উদ্যোগ নেয়নি। সড়কে অবস্থান করে একসময় ক্লান্ত হয়ে সরে যাবেন, এমন ধারণা থেকেই তাঁদের শান্ত করতে কোনো আশ্বাস দেওয়া হয়নি।