ডাকাতির গুজব, ইসিবি চত্বরে আসলে কী ঘটেছিল

জমি দখলকে কেন্দ্র করে অস্থায়ী স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। ইসিবি চত্বর এলাকায়। আজ দুপুরে তোলা ছবি।প্রথম আলো

রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন ইসিবি চত্বর এলাকায় ডাকাতি হচ্ছে—গতকাল বুধরাত রাত নয়টার দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ আটক ডাকাতের ছবিও প্রকাশ করে জনসাধারণকে সতর্ক করেছেন। ওই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর মিরপুর এলাকায় খবর ছড়ায়, ইসিবি চত্বরে যেসব ডাকাত নেমেছে, তারা মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঢুকছে।

এ খবরে গতকাল রাতভর মিরপুর–১০, মিরপুর–১১, মিরপুর–১২, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও ইব্রাহিমপুর এলাকার বাসিন্দারা জেগে এলাকা পাহারা দিয়েছেন। এসব এলাকার প্রায় প্রতিটি মসজিদের মাইকে ‘ডাকাত এসেছে, সবাই সতর্ক হোন, রাস্তায় নেমে আসুন’—এমন ঘোষণাও দেওয়া হয়। মিরপুরের বাসিন্দারা গতকাল বুধবার সারা রাত ডাকাত–আতঙ্কে পার করেছেন।

মিরপুর–১২ নম্বর এলাকার বাসিন্দা কায়সার এলাহী প্রথম আলোকে বলেন, বুধবার রাত ১১টার পর থেকে ফেসবুকে কেবল ডাকাতির খবর দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। পর তাঁর বাসার পাশের মসজিদে রাত তিনটার দিকে ঘোষণা দেওয়া হয়, এলাকায় ডাকাত ঢুকেছে। আতঙ্কের এক রাত পার করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানতে চেয়েছেন, তাঁর ফেসবুকে থাকা বা পরিচিতদের মধ্যে কেউ আসলে ডাকাতের কবলে পড়েছেন কি না, তা তিনি জানতে চান। তবে কেউ সাড়া দেননি।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক ইসিবি চত্বর এলাকায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, সেখানে আসলে কী ঘটেছিল। প্রথমে ইসিবি চত্বরে গিয়ে কয়েকজন দোকানির কাছে জানতে চাইলে বললেন, এ বিষয়ে তাঁরা কিছুই জানেন না। পরে একটি বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরীর কাছে ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি যে বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে, ওই বাড়ি দেখিয়ে দেন।

পরে সেখানে গিয়ে ভুক্তভোগী এক নারীকে পাওয়া গেল। তাঁর ঘরের সব আসবাব নিয়ে গেছে বলে জানান তিনি। কী ঘটেছিল, জানতে চাইলে নাজমা আক্তার নামের এক নারী প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল এশার নামাজের পর একদল যুবক এসে তাঁদের বাসায় হামলা চালান। একপর্যায়ে ঘরের সবকিছু লুট করে নিয়ে যান।

কারা এসব করেছে, জানতে চাইলে বলেন, তাঁরা যে জায়গায় বসবাস করছেন, জায়গাটি ‘নিউ গিনি প্রপার্টিজ লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান দখল করে নিতে চায়। এ জন্য মিরপুর থেকে শত শত লোক ভাড়া করে নিয়ে এসেছিল। যাদের ভাড়া করে নিয়ে এসেছিল, তাদের হাতে দেশি অস্ত্র ছিল। তাঁরা যে জায়গায় বসবাস করেন, সেটি ‘অনলাইন গ্রুপ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জমি। নাজমা আক্তার জানালেন, পাশেই নিউ গিনি প্রপার্টিজ লিমিটেড আবাসন।

পরে সেখানে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে সেখানে দায়িত্বরত দুজন নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ‘মালিক ভেতরে আছেন। আপনি অপেক্ষা করেন।’ এরপর এক যুবককে ভেতরে পাঠান তাঁরা। কিছুক্ষণ পর ওই যুবক এসে বলেন, ‘মালিক ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউ নেই।’

মূলত জমি দখলকে কেন্দ্র করে ইসিবি চত্বর এলাকায় কয়েকটি বাসাবাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। যেসব বাড়িঘরে হামলা হয়েছে, সেসব বাড়ি টিন দিয়ে তৈরি। সেখানে জমির মালিকের পক্ষে কয়েকজন লোক বসবাস করেন। তাঁরা জমি দেখাশোনার পাশাপাশি মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করেন।

এদিকে ইসিবি চত্বরে ডাকাতির কথা শুনে মিরপুর–১১ নম্বর এলাকায় পৌঁছানোর পর ওই এলাকার লোকজন লাঠিসোঁটা হাতে রাস্তায় নেমে আসেন। কিছুক্ষণ পরপর মিরপুর–১১ নম্বরের নান্নু মার্কেট এলাকায় বায়তুল এহতেরাম জামে মসজিদ থেকেও ডাকাত আসার খবর দিয়ে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানানো হয়।

ওই এলাকায় রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ছিলেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। সরেজমিনে দেখা যায়, কিছুক্ষণ পরপর লোকজন ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করে বিভিন্ন অলিগলিতে দৌড়াচ্ছেন। অচেনা কাউকে এলাকায় দেখলেই চিৎকার করছেন। তবে রাতভর পাহারা দিয়েও কোনো ডাকাত খুঁজে পাননি তাঁরা।

তবে ভোর সাড়ে চারটার দিকে সড়কে অবস্থানরত শত শত মানুষ ডাকাত সন্দেহে এক যুবককে আটক করেন। তাঁকে মারধর করে রক্তাক্ত করেন। পরে ওই যুবক জানান, তিনি ডাকাত এসেছে শুনে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। হঠাৎ লোকজনের হাতে লাঠিসোঁটা দেখে দৌড় দিয়েছেন। এতেই তাঁকে ডাকাত সন্দেহ করে মারধর করা হয়েছে। ডাকাত সন্দেহে আটক যুবকের পুরো শরীর তল্লাশি করে কিছুই পাওয়া যায়নি। এমনকি ওই যুবকের কাছে মুঠোফোনও পাওয়া যায়নি।