প্লট বরাদ্দ
মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের জন্য রাজউকের ‘উপহার’
রাজউকের প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত বর্তমান বিধিমালায়, মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যদের জন্য বিশেষ কোনো সুবিধা নেই।
মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সরকারি প্লট পাওয়া আরও সহজ করতে যাচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, কোনো মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের পরিবারের কেউ আগে প্লট পেয়ে থাকলে নতুন করে তাঁদের প্লট পাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এখন রাজউক যে নিয়ম করতে যাচ্ছে, তাতে কোনো মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের স্ত্রী, সন্তান, স্বামী আগে প্লট পেয়ে থাকলেও তাঁরা নতুন করে আরেকটি প্লট পাবেন।
রাজউকের প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত বিধিমালা সংশোধন করে এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যেই এর খসড়া তৈরি করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। খসড়াটির নাম দেওয়া হয়েছে রাজউক ভূমি বরাদ্দ বিধিমালা-২০২২।
তবে নগর–পরিকল্পনাবিদেরা মনে করেন, বিধিমালা সংশোধনের নামে রাজউক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ সুবিধা দিতে যাচ্ছে। কার্যত রাজউকের পক্ষ থেকে এটি ক্ষমতাবানদের জন্য একধরনের ‘উপহার’।
এমন অনেক ক্ষমতাবান পরিবার আছে, যারা রাজউক থেকে একাধিক প্লট পেয়েছে। মূলত তাদের জন্যই বিধিমালা সংশোধন করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া ক্ষমতাবানদের প্রতি রাজউকের একধরনের উপহার।মোহাম্মদ ফজলে রেজা, সভাপতি, বিআইপি
রাজউক এখন প্লট বরাদ্দ দেয় ১৯৬৯ সালের প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত বিধিমালা অনুসারে। এই বিধিমালা অনুসারে রাজউক কোনো আবাসিক প্রকল্প নিলে প্লট বরাদ্দের জন্য গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন আহ্বান করে। পরে আবেদন যাচাই-বাছাই করে যোগ্যদের প্লট বরাদ্দ দেয়।
তবে এই বিধিমালায় ১৯৮৬ সালে নতুন একটি উপবিধি (১৩–এ) যুক্ত করা হয়, যা সংরক্ষিত কোটা নামে পরিচিত। এই কোটাতেই মূলত মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের প্লট বরাদ্দ দেয় রাজউক। এই উপবিধিতে বলা হয়েছে, কেউ সরকারি চাকরিতে অবদান, জনসেবা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলে কোটায় প্লট পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। সে ক্ষেত্রে প্লট বরাদ্দ পেতে আগ্রহী ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী কিংবা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অর্থাৎ সরকার বরাবর আবেদন করতে হয়। সরকারের অনুমোদন পেলে সেটি রাজউকের বোর্ড সভায় বা সাধারণ সভায় উত্থাপন করতে হয়। বোর্ড সভায় প্লট বরাদ্দের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।
প্লট বরাদ্দ দেওয়া সংক্রান্ত রাজউকের নথিতে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের ‘অবদান’ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য থাকে না। ফলে এই কোটায় প্লট বরাদ্দ দিয়ে বিতর্ক হয়। এ ছাড়া ১৯৬৯ সালের বিধিমালার ৯ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে, প্লট পাওয়ার জন্য আবেদনকারী ব্যক্তির নিজের নামে, স্বামী/স্ত্রীর নামে কিংবা পরিবারের সদস্যের নামে রাজউকের আওতাধীন এলাকায় কোনো আবাসিক জমি, বাড়ি, প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দ কিংবা লিজ পেয়ে থাকলে তিনি প্লট বরাদ্দ পাবেন না।
২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সংরক্ষিত কোটায় রাজউকের প্লট পেয়েছেন অন্তত ২৮৫ জন। তাঁদের মধ্যে ১৪৯ জনই সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্য। প্লট বরাদ্দ পাওয়া সংসদ সদস্যদের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও (সংসদ সদস্য) রয়েছেন, যাঁর নিজের নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে ঢাকা শহরে এক বা একাধিক ফ্ল্যাট আছে। শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার পূর্বাচলে একটি প্লট পেয়েছেন।
যদিও ঢাকা শহরে তাঁর পৈতৃক বাড়ি আছে। জাতীয় পার্টির রাজনীতিকদের মধ্যে ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ পূর্বাচলে সাড়ে ৭ কাঠার একটি প্লট নিয়েছেন। নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী, তাঁর স্ত্রীর নামেই ২০টি ফ্ল্যাট আছে। এ ছাড়া ২০১২ সালে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী পূর্বাচলে ১০ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ পান। এর আগে তাঁর স্ত্রী ফাহিমা খাতুন উত্তরায় তিন কাঠার একটি প্লট পেয়েছিলেন।
রাজউকের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলছেন, এবার যে খসড়াটি করা হয়েছে, সেটি পাস হলে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের প্লট দেওয়া নিয়ে আর কোনো বিতর্ক থাকবে না। সরকার চাইলে (প্লট থাকা সাপেক্ষে) সব মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের (স্বনির্ভর) প্লট দিতে পারবে। কারণ খসড়া বিধিমালায় রাজউক এলাকায় প্লট বা বাড়ি থাকলে আর প্লট পাওয়া যাবে না এমন শর্ত নেই।
বরং খসড়ায় বলা হয়েছে, এই বিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন—মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী বা সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি এবং জাতীয় সংসদের সদস্যরা সরকারের অনুশাসন সাপেক্ষে আবাসিক প্লট বরাদ্দ পাবেন। তাঁদের স্ত্রী বা স্বামী ও সন্তানেরা স্বনির্ভর হলে এবং তাঁরা আগে প্লট পেলেও সংসদ সদস্যরা প্লট পাওয়ার যোগ্য হবেন।
রাজউকের এই খসড়া বিধিমালাকে বৈষম্যমূলক বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এমন অনেক ক্ষমতাবান পরিবার আছে, যারা রাজউক থেকে একাধিক প্লট পেয়েছেন।
মূলত তাঁদের জন্যই বিধিমালা সংশোধন করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া ক্ষমবানদের প্রতি রাজউকের একধরনের উপহার। তিনি বলেন, রাজউক এখন পর্যন্ত যতগুলো প্লট প্রকল্প নিয়েছে, এর মূল সুবিধাভোগী সমাজের উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তরা। প্লট বরাদ্দের বিধিমালা সংশোধন করে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের প্লট দিতে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ায় সমাজে বৈষম্য আরও বাড়বে। রাজউকের কাজ করা উচিত এমন মানুষদের নিয়ে, যাদের প্লট কেনার সামর্থ্য নেই।
এখন সংসদ সদস্যদের আবেদনের ভিত্তিতে মূলত পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ দেয় রাজউক। এ ছাড়া সংরক্ষিত কোটায় উত্তরা এলাকাতেও ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের প্লট দেওয়া হয়। আগামী দিনে আরও দুটি আবাসন প্রকল্প নিতে পারে রাজউক, এমন আলোচনা রয়েছে।
স্বামী-স্ত্রী উভয়ের প্লট পাওয়ার সুযোগ
প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত বর্তমান বিধিমালা অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পৃথক দুটি প্লট পাওয়ার সুযোগ নেই। এরপরও কোনো পরিবারের দুজন (স্বামী-স্ত্রী) দুটি পৃথক প্লট বরাদ্দ পেলে রাজউক যেকোনো একটি রেখে অন্যটির বরাদ্দ বাতিল করে দেয়। স্বামী–স্ত্রী দুজনই প্লট পেয়েছেন—এমন এক দম্পতির পাওয়া দুটি প্লটের একটি গত জানুয়ারি মাসে রাজউকের বোর্ড সভায় বাতিল করে দেওয়া হয়।
খসড়া বিধিমালার ৭ (১) উপবিধি অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের নামে আলাদা আয়কর থাকলে এবং তারা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল না হলে ও দুজনের বৈধ আয়ের উৎস থাকলে—দুজনই দুটি করে প্লট পাওয়ার যোগ্য হবেন। আবার প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এখন একটি প্লট পেলেও খসড়া পাস হওয়ার পর ওই পরিবারের আরও একটি প্লট পাওয়ার সুযোগ থাকবে।
এ ছাড়া রাজউকের কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিংবা আবাসন প্রকল্পের কারণে বাস্তুচ্যুত হলে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে ওই পরিবারেরও দুটি প্লট পাওয়ার সুযোগ থাকবে। একটি ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে এবং অন্যটি সাধারণ আবেদনকারী হিসেবে।
খসড়া বিধিমালার বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, খসড়া বিধিমালাটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় একটি কমিটি করেছে। এই কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রণালয় বিধিমালাটি চূড়ান্ত করবে। মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের বেশি সুবিধা দেওয়ার জন্য বিধিমালার খসড়ায় পৃথক একটি বিধি রাখা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, খসড়াটি করা হয়েছে রাজউকের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে।
‘নিবেদিতপ্রাণ’ সমাজকর্মীদের জন্যও সুযোগ
জাতীয় সংসদ সদস্যদের পাশাপাশি ‘সমাজসেবকদের’ প্লট পাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে রাজউকের খসড়া বিধিমালায়। এ জন্য ‘নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী’ ও ‘সমাজসেবকদের’ জন্য পৃথক উপবিধি যুক্ত করা হয়েছে। খসড়া বিধিমালার উপবিধি ১১ (চ) অনুযায়ী, কেউ সমাজকর্মী বা সমাজসেবক হলে তিনিও বিশেষ সুবিধায় প্লট পাওয়ার যোগ্য হবেন। কিন্তু উপবিধিতে উল্লেখ নেই, ঠিক কোন ধরনের বা কোন কাজের জন্য একজন ব্যক্তিকে সমাজকর্মী ও সমাজসেবক বলা হবে।
মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের বাইরেও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা এই উপবিধির সুবিধা নেবেন বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, কোন মাপকাঠিতে একজন ব্যক্তিকে নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী হিসেবে নির্বাচন করা হবে এবং কারা নির্বাচন করবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
সাধারণত দেখা যায়, রাজনৈতিক বিবেচনাতেই নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী নির্বাচন করা হয়। বিভিন্ন পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রেও তেমনটি দেখা যায়। আর যেভাবে রাজউক প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত বিধিমালা সংশোধন করতে যাচ্ছে তাতে মূলত সুবিধা পাবেন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা, এটি অগ্রহণযোগ্য ও বৈষম্যমূলক।