রাজধানীর পান্থকুঞ্জ পার্ক কোনোভাবেই ধ্বংস করে সেখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা যাবে না। সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলে ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলের প্রাণপ্রকৃতি বিধ্বংসী ও জনবিরোধী এই প্রকল্প বন্ধ করা হবে।
দেশের পরিবেশ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নাগরিক ও নগর পরিকল্পনাবিদের ৩১টি সংগঠন নাগরিক সংলাপে একমত হয়ে এই দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই সংলাপ হয় পান্থকুঞ্জের পাশে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সম্মেলনকক্ষে।
‘হাতিরঝিল ও পান্থকুঞ্জ ধ্বংস করে এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের সংযোগ সড়ক বাতিলের দাবি’ শিরোনামে এই সংলাপ হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ধরিত্রী বাঁচাও আন্দোলনের উপদেষ্টা অধ্যাপক মুজিবুর রহমান হাওলাদার।
সংলাপে মূল প্রবন্ধ পড়েন নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্বের অন্যতম যানজট ও বায়ুদূষণের শহর। এখানে পার্ক, উদ্যান, সবুজ এলাকা প্রয়োজনের ১০ শতাংশও নেই। উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলোকে ঢাকা শহর বাইপাস করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য ২০১১ সালে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। কিন্তু কাজ হয়েছে উল্টো। ঢাকাকে বাইপাস না করে বরং শহরের মধ্য দিয়ে সড়কটি চলে গেছে। আর শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে জালের মতো র্যাম্প যুক্ত করে গাড়ির ওঠানামার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব স্থানে যানজট আরও বেড়েছে।
আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, দফায় দফায় মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ হাজার ৯৭১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। বিগত সরকারের জনমতবিহীন অবকাঠামোগত উন্নয়ন তত্ত্বের উদাহরণ হয়ে আছে এই প্রকল্প। এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গণপরিবহনের মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ চলাচল করে। বাকি সব ব্যক্তিগত গাড়ি।
এই প্রকল্পে ‘সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রজেক্ট’ নামে মগবাজার রেলক্রসিং থেকে সোনারগাঁ হোটেল, পান্থকুঞ্জ, হাতিরপুল, কাঁটাবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে পলাশী মোড় পর্যন্ত লিংক বা সংযুক্ত সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে ইতিমধ্যেই হাতিরঝিল অংশে ভরাট করা হয়েছে, পান্থকুঞ্জের অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, এই সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রক্রিয়ায় ইতিমধ্যেই হাতিরঝিল ও পান্থকুঞ্জ ধ্বংস হয়েছে। সড়কটি নির্মিত হলে কাঁটাবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট এলাকায় যানজট আরও বাড়াবে। অবিলম্বে এটি বাতিল করতে হবে। হাতিরঝিলে স্থাপিত পিলারগুলো সরিয়ে জলাধারের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। পান্থকুঞ্জের কাজ বন্ধ করে গাছ লাগিয়ে পার্কটির আগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। একই সঙ্গে এই সংযোগ সড়কের নকশা প্রণয়নকারী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
নাগরিক সংলাপের আয়োজক সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ (ইআরডিএ), নারীপক্ষ, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি),বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। সঞ্চালনা করেন পরিবেশকর্মী ও গবেষক পাভেল পার্থ।
প্রকল্প বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে
সংলাপের শুরুতে বলা হয়, পান্থকুঞ্জ রক্ষার দাবিতে সেখানে গত ১০ ডিসেম্বর থেকে টানা ৩৫ দিন ধরে পান্থকুঞ্জ প্রভাতি সংঘ এবং বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা অবস্থান করছেন। তাঁরা শীত, যানবাহনের উচ্চ শব্দ, মশার উপদ্রব সহ্য করে নগরীর বুকের এই একটুকরা সবুজ রক্ষায় কষ্টকর আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে এবং পান্থকুঞ্জ রক্ষার দাবিতেই এই নাগরিক সংলাপ আয়োজন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব প্রথম আলোকে বলেন, সংযোগ সড়ক প্রকল্প বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা তাঁদের অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। সরে যেতে তাঁদের ওপর বিভিন্ন মহল থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে, আক্রমণ করা হয়েছে। কিন্তু তাঁরা অনড় থাকবেন।
সংলাপে আলোচনাকালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান বলেন, এত বিপুল অর্থ খরচ করে হাতিরঝিল প্রকল্প করা হলো। সেখান থেকে বিজিএমইএর ভবন ভেঙে ফেলা হলো। অথচ উন্নয়ন প্রকল্পের দোহাই দিয়ে হাতিরঝিল নষ্ট করা হচ্ছে। পান্থকুঞ্জকে বলা হয় ঢাকার একটি ফুসফুস। সেটিও ধ্বংস করা হলো। ঢাকার জলাভূমি কারা গ্রাস করছে? ঢাকা মহানগরের পরিবেশ নষ্ট হলো কেন? কারা করছে? এসব নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার। এটা করা না গেল শহরকে বসবাসযোগ্য করা যাবে না।
নগর পরিকল্পনাবিদ ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শায়ের গফুর বলেন, ‘শুধু রাজধানী নয়, উন্নয়নের নামে সারা দেশেই ভূমির ধরন পরিবর্তন করে ভূমিকে নষ্ট করা হচ্ছে। এভাবে জায়গা হারিয়ে গেলে, তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না। ভবিষ্যতের জন্য তা ঘোরতর সংকট হয়ে দেখা দেবে। এই প্রক্রিয়া অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।’
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, কোনো পূর্ব সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই মেগা প্রকল্পগুলো মোটেই পরিবেশ ও জনবান্ধব নয়। সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই এগুলো করা হয়েছে। এগুলো জনগণ ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজ। এর জন্য বিচার হওয়া প্রয়োজন।
সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সাফিয়া আজিম বলেন, ঢাকার সব মাঠ পার্ক দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। শিশুদের খেলাধুলার জায়গা নেই। সকাল-সন্ধ্যায় হাঁটার পর্যাপ্ত জায়গা নেই। যৎসামান্য যাও বা আছে সেগুলো নারীবান্ধব নয়। মাঠ–পার্কে নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির প্রতি তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন।
ধরার সদস্যসচিব শরীফ জামিল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার আগের আমলের অনেক গণবিরোধী ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিল করেছে। পান্থকুঞ্জ রক্ষায় এই প্রকল্পও বাতিল করতে হবে। প্রয়োজন হলে বিকল্প কোনো দিক দিয়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে পারে।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘কোনোভাবেই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা চলবে না। হাতিরঝিল, পান্থকুঞ্জ ধ্বংস করা চলবে না। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই, এটা বন্ধ করুন।’