পর্যটন করপোরেশনের মদের বিক্রয়কেন্দ্রে আয় নেই, লোকসান কোটি টাকা

কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই এক বছর আগে রাজধানীর মহাখালীতে কূটনীতিকদের জন্য মদের বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে পর্যটন করপোরেশন। বিক্রয়কেন্দ্র চালুর আগে নেওয়া হয়নি কারও মতামত, করা হয়নি কোনো ধরনের সমীক্ষা। বিদেশি কূটনীতিকেরাও সরকারের কাছে এমন সুবিধা চাননি। চালুর পর গত এক বছরে এক টাকার মদও বিক্রি হয়নি।

লোকসানের মুখে করপোরেশন এখন নিজেরাই মদের বন্ডেড ওয়্যারহাউসের লাইসেন্স বাতিল করতে চায়। জুনের প্রথম সপ্তাহে লাইসেন্স বাতিল করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। এনবিআর এখন আবেদনটি যাচাই–বাছাই করছে। লাইসেন্স বাতিলের চিঠি এখনো পাননি বলে জানিয়েছেন পর্যটন করপোরেশনের পরিচালক (প্রশাসন) এ কে এম তারেক।

পর্যটন মন্ত্রণালয়ের চিঠি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কূটনীতিকদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য কেনাকাটার সেবা দিতে ২০২২ সালের ২৫ মে পর্যটন করপোরেশনকে বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স ইস্যু করে এনবিআর। পরের বছর ২৫ মে থেকে মহাখালীতে অবস্থিত পর্যটন করপোরেশনের হোটেল অবকাশের নিচতলায় মদের প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র চালু হয়। নিয়ম অনুযায়ী, একজন বিদেশি কূটনীতিক তাঁর কার্ড দেখিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য কিনতে পারবেন।

কূটনীতিকেরা মদের পাশাপাশি একই ছাদের নিচে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় কিনতে চান; কিন্তু পর্যটন করপোরেশন তা দিতে পারছে না।

করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, চালুর পর থেকে গত এক বছরে কোনো কূটনীতিক শুল্কমুক্ত সুবিধায় সেখানে মদ কিনতে যাননি। বিক্রয়কেন্দ্রে না যাওয়ার কারণ হিসেবে এনবিআরে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, করপোরেশন সেখানে শুধু মদ বিক্রি করে। কূটনীতিকেরা মদের পাশাপাশি একই ছাদের নিচে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় কিনতে চান; কিন্তু পর্যটন করপোরেশন তা দিতে পারছে না। সে কারণে বিদেশি কূটনীতিকেরা সেখানে যেতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে করপোরেশনকে। ক্রমাগত লোকসান দিয়ে বিক্রয়কেন্দ্র চালু রাখার মতো সক্ষমতা তাঁদের নেই।

পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, মদের বিক্রয়কেন্দ্র চালুর আগে কোনো সমীক্ষা করা কিংবা কারও মতামত নেওয়ার নথিপত্র তাঁর চোখে পড়েনি। তিনি বলেন, মহাখালীতে মদের বিক্রয়কেন্দ্র চালুর সিদ্ধান্ত ছিল খামখেয়ালি। তাঁর মতে, স্থানটি মদের বিক্রয়কেন্দ্রের জন্য আদর্শ নয়। এক বছরে এক টাকার মদও বিক্রি হবে না, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

করপোরেশনের তথ্যমতে, কূটনীতিকদের জন্য স্থাপিত মদের বিক্রয়কেন্দ্র থেকে গত এক বছরে এক টাকাও আয় হয়নি। এর মধ্যে লাইসেন্স নবায়নের জন্য ৭ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।

এদিকে বিদেশি কূটনীতিকেরা যাতে করপোরেশনের মদের বিক্রয়কেন্দ্রে আসেন, সে জন্য তাঁদের ই-মেইল করা হয়। আলাদা করে বার্তা দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়। তবে নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বিক্রয়কেন্দ্র চালুর পর। চালুর আগে কাউকে জানানো হয়নি।

করপোরেশনের তথ্যমতে, কূটনীতিকদের জন্য স্থাপিত মদের বিক্রয়কেন্দ্র থেকে গত এক বছরে এক টাকাও আয় হয়নি। এর মধ্যে লাইসেন্স নবায়নের জন্য ৭ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। আবার হোটেল অবকাশে আগে বেকারি ও পেস্ট্রি শপ ছিল। সেখান থেকে প্রতি মাসে ৭ লাখ টাকা অর্থাৎ বছরে ৮৪ লাখ টাকা আয় হতো। মদের বন্ডেড হাউস দেওয়ার পর বেকারি ও পেস্ট্রি শপ তুলে দেওয়া হয়। এতে করপোরেশনকে বছরে ৯১ লাখ টাকার মতো লোকসান গুনতে হচ্ছে।

করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, করপোরেশন নিজেদের আয় দিয়ে চলে। প্রতিবছর এক কোটি টাকা লোকসান দিয়ে মদের বিক্রয়কেন্দ্র চালু রাখার মতো অবস্থায় তারা নেই। তাই মদের বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স বাতিল করতে এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

মহাখালীতে মদের বিক্রয়কেন্দ্রে কূটনীতিকেরা শুধু মদ কিনতে যেতে চান না। একটি সুপারশপে যত ধরনের পণ্য পাওয়া যায়, সব পণ্য পেতে চান। কিন্তু এত বড় পরিসরে ওয়্যারহাউস করার মতো সক্ষমতা করপোরেশনের নেই।
পর্যটন করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (ডিএফও) শওকত ওসমান

পর্যটন করপোরেশনের তথ্য বলছে, সারা দেশে তাদের ৫১টি হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ ও বার রয়েছে। এর মধ্যে করপোরেশন পরিচালনা করে ৩৫টি ইউনিট, ইজারা দেওয়া হয়েছে ১৬টি। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেশির ভাগ ইউনিট লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আয় করতে পারছে না। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে টানা লোকসানে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। গত অর্থবছর (২০২২-২৩) পর্যন্ত গড়ে ১০ কোটি টাকা করে লোকসান গুনতে হয়েছে।

পর্যটন করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (ডিএফও) শওকত ওসমান প্রথম আলোকে বলেন, মহাখালীতে মদের বিক্রয়কেন্দ্রে কূটনীতিকেরা শুধু মদ কিনতে যেতে চান না। একটি সুপারশপে যত ধরনের পণ্য পাওয়া যায়, সব পণ্য পেতে চান। কিন্তু এত বড় পরিসরে ওয়্যারহাউস করার মতো সক্ষমতা করপোরেশনের নেই।