যা শুরু হয়, তার শেষ আছে। অধিবর্ষ এবং বর্ধিত মেয়াদের পরে অমর একুশের বইমেলা শেষ হলো গতকাল শনিবার। শেষ হওয়ার সঙ্গে সাধারণত একধরনের বিষণ্নতা জড়িয়ে থাকে। বইমেলার শেষ দিনটিতে মেলা সাঙ্গ হওয়ার বিষণ্নতাবোধের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল বৃহস্পতিবার রাজধানীর নিউ বেইলি রোডের ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু ও দগ্ধ হওয়ার শোক।
এর ফলে মেলার শুরুটা আনন্দে হলেও শেষ দিনে মেলার পরিবেশ হয়ে উঠেছিল বেদনাবিষণ্ন। বর্জন করা হয়েছিল পূর্বনির্ধারিত সমাপনী দিনের আতশবাজি। মৃত ব্যক্তিদের স্মরণের গভীর শোক প্রকাশ করে সমাপনী অনুষ্ঠানে পালন করা হলো এক মিনিট নীরবতা।
প্রকাশকেরা আশাবাদী
এবার মেলায় বই বিক্রি নিয়ে প্রকাশক ও স্টলের ব্যবস্থাপকেরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। অ্যাডর্নের প্রকাশক সৈয়দ জাকির হোসাইন বললেন, বিক্রি যেমন হয়েছে, তা সন্তুষ্ট হওয়ার মতো। তবে এবার গতানুগতিক বইয়ের চেয়ে বিষয়বৈচিত্র্যের বইগুলোর প্রতি পাঠকদের আগ্রহ বেশি দেখা গেছে। এটা ভালো দিক। তিনি বললেন, কেবল ছুটির দিনে নয়, মেলা প্রতিদিনই বেলা ১১টা থেকে শুরু করা যেতে পারে। তিনি মনে করেন, ঢাকায় মেলা শেষ হলেও সারা বছর বিভিন্ন জেলায় মেলার আয়োজন করা প্রয়োজন। মানুষকে আরও বেশি করে বইয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
সময় প্রকাশনের প্রকাশক ফরিদ আহমদ বললেন, বিক্রি খুব ভালো, তা বলা যায় না। আবার একেবারে মন্দও নয়। কয়েক বছর ধরে যে গভীর মন্দা সৃষ্টি হয়েছিল, সেখান থেকে উঠে আসার একটা সম্ভাবনা শুরু হলো এমন বলা যায়। অনুপমের প্রকাশক মিলন নাথ, ঐতিহ্য প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন, অবসরের ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা, ঘাসফুলের প্রকাশক আদিবা নুসরাসহ অনেকেই বললেন, করোনার পরে এবারই বইমেলা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে।
বই এসেছে তিন সহস্রাধিক, বিক্রি ৬০ কোটি টাকা
বাংলা একাডেমি জানিয়েছে, তাদের হিসাবে এবার মেলায় প্রায় ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। একাডেমির প্যাভিলিয়ন ও প্রধান বিক্রয়কেন্দ্রে শুক্রবার পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। গতকাল সমাপনী দিনেও একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে নতুন প্রকাশিত ১৪৯টি নতুন বইয়ের নাম জমা পড়েছে। এ নিয়ে এবার মেলায় মোট নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৭৫১টি। গত বছর নতুন বইয়ের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭৩০। এবার কবিতা ১ হাজার ২৬২টি, উপন্যাস ৫৪০টি ও গল্প ৫২টি।
সমাপনী অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণী
বিকেলে একাডেমির মাঠের মূল মঞ্চে ছিল সমাপনী অনুষ্ঠান। একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা কবি কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান ও সংস্কৃতিসচিব খলিল আহমদ। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা।
আলোচনার পরে ছিল পুরস্কার বিতরণী। সর্বাধিক মানসম্মত বইয়ের জন্য কথাপ্রকাশের প্রকাশক জসিম উদ্দিন চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার, মানসম্মত বই বিভাগে প্রথমা প্রকাশনের মনজুর আহমদের একুশ শতকে বাংলাদেশ: শিক্ষার রূপান্তর–এর জন্য মেরিনা ইয়াসমিন, মঈন আহমদের লেখা যাত্রাতিহাস: বাংলার যাত্রাশিল্পের আদিঅন্ত–এর জন্য ঐতিহ্যের প্রকাশক আরিফুর রহমান, আলমগীর সাত্তারের কিলো ফ্লাইট বইয়ের জন্য জার্নিম্যান
বুকসের পরিচালক নাজনীন হক মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার গ্রহণ করেন। এ ছাড়া সর্বাধিক মানসম্মত শিশুতোষ বইয়ের জন্য ময়ূরপঙ্খির প্রকাশক মিতিয়া ওসমান রোকনুজ্জামান খান স্মৃতি পুরস্কার নেন। এ ছাড়া প্যাভিলিয়ন ও স্টলের সাজসজ্জার জন্য কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে অন্য প্রকাশ, নিমফিয়া পাবলিকেশন ও বেঙ্গল বুকস। অতিথিরা পুরস্কারপ্রাপ্তদের হাতে ক্রেস্ট, সনদ ও পুরস্কারের অর্থ তুলে দেন।
আজ থেকে আর বেলা গড়ালে মেলায় যাওয়ার টান পড়বে না। হয়তো এক রকম শূন্যতার বোধ জাগবে মনে। মিলনমেলার মাঠ ছেয়ে যাবে বসন্তের ঝরাপাতায়।