ঢাকায় ৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত মাস ২০২৪-এর ডিসেম্বর

বায়ুদূষণফাইল ছবি

বায়ুদূষণে একাধিক রেকর্ড হয়েছে সদ্য বিদায়ী ২০২৪–এর ডিসেম্বর মাসে। এ মাসে যত বায়ুদূষণ ছিল, তা গত ৯ বছরে সর্বোচ্চ। ১৪ ডিসেম্বর দূষণের মাত্রা যে অবস্থায় পৌঁছেছিল, তা এই পর্যন্ত কখনো দেখা যায়নি। বায়ুর মান খুব খারাপ হলে তাকে বলা হয় ‘দুর্যোগপূর্ণ।’ ৯ বছরে ৯টি ডিসেম্বর মাসের মোট ১৭ দিন বায়ু ছিল দুর্যোগপূর্ণ। আর এর মধ্যে ১১ দিনই বায়ু দুর্যোগপূর্ণ ছিল গত ডিসেম্বরে।

ঢাকার বায়ুদূষণের এই ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। গতকাল বুধবার নতুন গবেষণায় গত ডিসেম্বর মাসসহ ৯ বছরের দূষণের অবস্থা তুলে ধরেছে প্রতিষ্ঠানটি।

দূষণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো উদ্যোগ বাস্তবে যে কাজে লাগছে না, দূষণের এ পরিস্থিতি সেই বার্তা স্পষ্ট করেছে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।

আমি প্রায় ছয় বছর ধরে একের পর এক প্রতিশ্রুতি শুনছি দূষণ কমানো নিয়ে। এখনো শুনছি; কিন্তু কোনো কাজ দেখছি না।
ইকবাল হাবিব, নগরবিদ ও পরিবেশবাদী

ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ইটভাটা ও কলকারখানার ধোঁয়া, ফিটনেসবিহীন গাড়ির দৌরাত্ম্য, যত্রতত্র বর্জ্য পোড়ানো, নিয়ন্ত্রণহীন নির্মাণকাজ—দূষণের এসব উৎস বন্ধে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। এসব বন্ধে প্রকল্পের দরকার নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্রিয় তৎপরতাই যথেষ্ট; কিন্তু সেই তৎপরতা দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেই।

ক্যাপস ২০১৬ সাল থেকে বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করছে। দূষণের ক্ষেত্রে তারা দেখে, বাতাসে কতটুকু অতিক্ষুদ্র ধূলিকণা বা পিএম ২.৫ থাকে। এই ধূলিকণার মধ্যে কলকারখানা, যানবাহন ও রাস্তার ধুলাবালি একত্র হয়। আর সেই কণা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি এবং দীর্ঘ মেয়াদে বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করে।

বায়ুর মান শূন্য থেকে ৫০ থাকলে ‘ভালো’ বলা হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে ‘গ্রহণযোগ্য’। ১০১ থেকে ১৫০ ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ক্ষতিকর’, ১৫১ থেকে ২০০ ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১ থেকে ৩০০ ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০০–এর বেশি হলে তা হয় ‘দুর্যোগপূর্ণ’।

৯ বছরে দূষণের দিক থেকে দুর্যোগপূর্ণ দিন ছিল ৬৬টি। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসেই ছিল ১৭ দিন। আর গত ডিসেম্বরের ১১ দিন নগরবাসী কাটিয়েছে এই ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বায়ুর মধ্যে।

ডিসেম্বরে দূষণের রেকর্ড

ক্যাপসের গবেষণায় দেখা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরে বায়ুর গড় মান ছিল ২৮৮। ২০১৬ থেকে এত খারাপ কখনোই হয়নি। ২০২৩–এর ডিসেম্বরে বায়ুর মান ছিল ১৯৫। গত ৯ বছরে ডিসেম্বর মাসে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ২১৯ দশমিক ৫৪। ২০২৪–এর ডিসেম্বরে এই মান ৩১ ভাগের বেশি বেড়ে গেছে। আর ২০২৩ এর তুলনায় বেড়েছে ২৬ ভাগের বেশি।

ক্যাপসের গবেষণায় দিনের বিভিন্ন সময়ে বায়ুর মানের একটি হিসাব করা হয়েছে। সেখানে গত ডিসেম্বর মাসের ভয়াবহ দূষণচিত্র পাওয়া গেছে। গত ১৪ ডিসেম্বর রাত ১১টার সময় ঢাকার বায়ুর মান ছিল ৮৮০। এমনটি বাংলাদেশে গত ৯ বছরে কখনোই হয়নি।

৯ বছরে দূষণের দিক থেকে দুর্যোগপূর্ণ দিন ছিল ৬৬টি। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসেই ছিল ১৭ দিন। আর গত ডিসেম্বরের ১১দিন নগরবাসী কাটিয়েছে এই ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বায়ুর মধ্যে।

স্বাস্থ্যে ভয়াবহ প্রভাব

‘দুর্যোগপূর্ণ’ বায়ুতে নগরবাসীর স্বাস্থ্য ভালো নেই। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ২৫০ শয্যার টিবি (যক্ষ্মা) হাসপাতালে গত মাসে গড়ে ৪১০ এর বেশি রোগী এসেছে বহির্বিভাগে। এমনটা সাধারণত এ মাসে দেখা যায় না। আর শয্যায় রোগী ছিল গড়ে ১১৫। এ তথ্য জানিয়ে টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়শা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিসেম্বরের ভয়ানক দূষণের প্রতিফলন দেখা যায় আমাদের হাসপাতালে। দূষণ বেড়ে যাওয়ার এ সময়ে রোগীও বাড়ে, এটা আমরা সবসময় দেখি। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।’

নগরীর বায়ুর মানের উন্নয়নে কাজ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ অধিদপ্তরও। নানা সময়ে বিভিন্ন অভিযান করে দূষণের উৎস বন্ধের চেষ্টা করে তারা। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কর্মসূচির কথা জানানো হয়; কিন্তু বাস্তব অর্থে পরিবেশ অধিদপ্তরের তদারকি আসলে তেমন নেই।

ইটভাটা ও কলকারখানার ধোঁয়া, ফিটনেসবিহীন গাড়ির দৌরাত্ম্য, যত্রতত্র বর্জ্য পোড়ানো, নিয়ন্ত্রণহীন নির্মাণকাজ-দূষণের এসব উৎস বন্ধে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার, চেয়ারম্যান,  ক্যাপস

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, এবার নভেম্বরে পুলিশ কম থাকায় ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান বেশি হয়নি। রাস্তার আশপাশে বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে। আসলে ঢাকার দূষণ নিয়ন্ত্রণে সময় লাগবে।

এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন নগরবিদ ও পরিবেশবাদী ইকবাল হাবিব। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় ছয় বছর ধরে একের পর এক প্রতিশ্রুতি শুনছি দূষণ কমানো নিয়ে। এখনো শুনছি। কিন্তু কোনো কাজ দেখছি না। দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের দায়িত্বশীল যারা আছে, তারা আসলে প্রতারণা করছে।’