২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস। ওই মাসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে মোট সাতবার বিস্কুট কেনা হয়। এর মধ্যে পাঁচবার প্রতি কেজি বিস্কুট কেনা হয় ৩ হাজার ৬০০ টাকায়। বাকি দুবার কেনা বিস্কুটের দাম পড়ে প্রতি কেজি ৩ হাজার ২০০ টাকা।
কেনাকাটার ভাউচার সংগ্রহ করে দেখা যায়, বিস্কুটগুলো কেনা হয়েছে গুলশান-২ নম্বরের ডিএনসিসি মার্কেটের একটি দোকান থেকে। ভাউচারে বিস্কুটের নাম লেখা হয়নি। তবে বৃহস্পতিবার কামাল স্ন্যাক্স অ্যান্ড জেনারেল স্টোর নামের ওই দোকানটিতে গিয়ে ৩ হাজার ৬০০ কিংবা ৩ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়, এমন কোনো বিস্কুট পাওয়া যায়নি। ওই দোকানে সর্বোচ্চ যে দামের বিস্কুট আছে তার এক কেজির দাম হয় ২ হাজার ২৫০ টাকা।
এ ছাড়া গত বছরের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত, প্রতি মাসেই ৫-৬ কেজি করে বিস্কুট প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে কেনা হয়। ওই সময়ে বেশির ভাগ বিস্কুট কেনা হয়েছে প্রতি কেজি ৩ হাজার ৬০০ টাকায়। কয়েকবার অবশ্য বিস্কুটের দাম ৩ হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা দেখানো হয়েছে।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে এমন দামে বিস্কুট কেনা হয়েছে ‘ইমপ্রেস্টমানি’ বা পুনঃভরণযোগ্য অগ্রিম বরাদ্দের টাকায়। ওই দপ্তরে এ বাবদ বরাদ্দ মাসে ৫০ হাজার টাকা। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত (এপ্রিল বাদে) প্রতি মাসেই এ কর্মকর্তার দপ্তরে বরাদ্দের পুরো টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে উত্তোলন করা অর্থের পরিমাণ ৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে মার্চ ও মে মাসে বরাদ্দের দ্বিগুণ অর্থাৎ এক লাখ টাকা করে তোলা হয়েছে।
ওই সময় ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন সেলিম রেজা। এখন তিনি অবসরে আছেন। মুঠোফোনে সেলিম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাউচার যারা তৈরি করেছে, তারা কীভাবে করেছে, সেটা আমার নলেজে (অবগত) নাই। কাগজপত্র না দেখে মন্তব্য করা আমার জন্য মুশকিল।’ এ বাবদ টাকা খুবই অপ্রতুল ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা উত্তর সিটিতে ৪১ জন কর্মকর্তার জন্য এই অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। দপ্তর ও কর্মকর্তাভেদে ডিএনসিসিতে এ বরাদ্দের পরিমাণ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। এর বাইরে শুধু অঞ্চল-৫–এর কর কর্মকর্তার জন্য মাসে ৫ হাজার টাকা ইমপ্রেস্টমানি বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
ডিএনসিসি সূত্র জানায়, দাপ্তরিক কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের জরুরি কেনাকাটা করতে এই টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন বিভাগের ব্যয়ের বিবরণীতে দেখা যায়, ইমপ্রেস্টমানির বেশির ভাগ ব্যয় করা হয়েছে খাবারদাবার কেনা কিংবা আপ্যায়ন বাবদ। এগুলোর মধ্যে ভাত-তরকারি থেকে শুরু করে বিরিয়ানি-পোলাওসহ বিস্কুট, কফি, দুধ, চিনি, টি-ব্যাগ, পানি, বাদাম, কেক, কোমল পানীয়, চিপস, পরোটা, ডিম, সবজিভাজি ও ফলমূল রয়েছে।
৩,৬০০ টাকার বিস্কুট নেই
গুলশান–২ নম্বর গোলচত্বরের এক পাশে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়। এর সামনের সড়ক পার হলেই ডিএনসিসি মার্কেটের (সাবেক ডিসিসি মার্কেট)। বৃহস্পতিবার বিকেলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরের বিস্কুট কেনার ভাউচারগুলোর অনুলিপি নিয়ে ওই মার্কেটের কামাল স্ন্যাক্স অ্যান্ড জেনারেল স্টোরে যান প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। দোকানে তখন ছিলেন বিক্রয়কর্মী সৃজন আহমেদ ও অন্য আরেকজন বিক্রয়কর্মী। বেশি দামের বিস্কুট চাইলে তারা বিদেশি ব্র্যান্ডের চার ধরনের বিস্কুট দেখান।
এর মধ্যে ২০০ ও ২০৮ গ্রাম ওজনের মোড়কজাত দুটি ভিন্ন ব্র্যান্ডের বিস্কুটের খুচরা মূল্য ছিল ৪৫০ টাকা, যা ওই দোকানের সবচেয়ে বেশি দামের বিস্কুট বলে বিক্রেতারা জানান। এক কেজি সমপরিমাণের (২০০ গ্রামের ৫টি প্যাকেট) ওই দুই ধরনের বিস্কুটের দাম হয় ২ হাজার ২৫০ টাকা।
বিক্রেতাদের দেখানো অন্য দুটি ব্র্যান্ডের ২৫০ গ্রাম ওজনের মোড়কজাত বিস্কুটের খুচরা মূল্য ৫৬০ টাকা এবং ৩০০ গ্রাম ওজনের প্যাকেটের মূল্য ছিল ৫২০ টাকা। এক কেজি সমপরিমাণ হিসাব করলে ওই দুটি বিস্কুটের প্রতি কেজি দাম হয় ২ হাজার ২৪০ টাকা এবং ১ হাজার ৭০০ টাকা।
ডিএনসিসি থেকে সংগ্রহ করা বিস্কুট কেনার ভাউচার দেখানো হলে, ভাউচারটি তাদের দোকানের বলে বিক্রয়কর্মীরা শনাক্ত করেন। তবে হাতের লেখা কার, তা জানাতে পারেননি তাঁরা। ওই দোকানে পণ্য বিক্রির রসিদ বইয়ে কার্বন কপি বা বিক্রি হওয়া পণ্যের বিবরণের অনুলিপি (কার্বন কপি) নেই।
এখানে উল্লেখ্য যে ঢাকা উত্তর সিটিতে নতুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা যোগদানের পর তাঁর দপ্তরের জন্য কেনা বিস্কুটের দাম দেখানো হয়েছে প্রতি কেজি ১ হাজার ২০০ টাকা। গত ১৪ জানুয়ারি মীর খায়রুল ইসলাম সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন।
লাখ টাকার বিদায় অনুষ্ঠান
ইমপ্রেস্টমানির টাকা ব্যয় করে গত বছরের ২০ জুলাই ঢাকা উত্তর সিটির মেয়রের সাবেক একান্ত সচিবের বিদায় অনুষ্ঠান করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ৯৩ হাজার ৫১৫ টাকা। ভ্যাটসহ মোট ব্যয় ৯৯ হাজার ৭৪০ টাকা। এটি ব্যয় হয়েছে প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন বিভাগে বরাদ্দ দেওয়া ইমপ্রেস্টমানির টাকায়। ওই দপ্তরে প্রতি মাসে বরাদ্দের পরিমাণই এক লাখ টাকা। অর্থাৎ ওই কর্মকর্তার বিদায় অনুষ্ঠান আয়োজনে দপ্তরের পুরো মাসের টাকা ব্যয় করা হয়।
ব্যয়ের বিবরণীতে দেখা যায়, সাদা ভাত, করলাভাজি, ডাল, মুরগি, রুই মাছের ভুনা বাবদ ব্যয় করা হয়েছে ২৩ হাজার ২৫০ টাকা। এ ছাড়া ক্লাব স্যান্ডউইচ, সমুচা, সন্দেশ, কেক ও পানি কেনা বাবদ ব্যয় করা হয়েছে সাড়ে ২৩ হাজার টাকা। আরেক দফায় আবার চিকেন প্যাটিস, কেক, সমুচা ও পানি কেনা হয়েছে। তাতে ব্যয় হয়েছে আরও ২৩ হাজার ২৫০ টাকা।
জুলাইয়ে ওই বিদায় অনুষ্ঠান ছাড়াও আরও প্রায় দুই লাখ টাকা ব্যয় করে সমাজকল্যাণ বিভাগ। এর মধ্যে একটি ভাউচারে ৯৯ হাজার ৬৩১ টাকা, আরেকটি ভাউচারে ৯৯ হাজার ৫০৪ টাকা ব্যয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ব্যয়ের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়নি।
ব্যয়ের নীতিমালা নেই
ঢাকা উত্তর সিটিতে কর্মকর্তা ও দপ্তরভেদে বিভিন্ন পরিমাণে ইমপ্রেস্টমানির অর্থ বরাদ্দ থাকলেও এই অর্থ কোন খাতে, কীভাবে, কত ব্যয় করা হবে, সে বিষয়ে কোনো নীতিমালা নেই। যদিও রাজধানী ঢাকার আরেকটি সিটি করপোরেশন ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে এ–সংক্রান্ত একটি নীতিমালা রয়েছে। ওই নীতিমালায় ইমপ্রেস্টমানির টাকা কোন কোন খাতে ব্যবহার করতে পারবেন, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে করা ঢাকা দক্ষিণ সিটির ইমপ্রেস্টমানি ব্যয়ের নীতিমালায় ৩৩ জন কর্মকর্তার জন্য এ অর্থ বরাদ্দ করা হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার জন্য মাসে দুই লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। ব্যয়ের খাত হিসেবে বলা হয়েছে, প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক ব্যয়, চিঠিপত্র বিতরণ, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন, ফুড অ্যান্ড স্যানিটেশন কার্যক্রম, খাদ্য নমুনা পরীক্ষা ও ল্যাবে প্রেরণ ব্যয়, বিবিধ ব্যয়সহ বিভাগ ও দপ্তরের জরুরি তাৎক্ষণিক প্রয়োজন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির স্বাস্থ্য বিভাগের আওতাধীন নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকেরা জানান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করা খাবারের নমুনার দাম ওই ইমপ্রেস্টমানির টাকায় পরিশোধ করা হয়। এদিকে উত্তর সিটির স্বাস্থ্য বিভাগের পরিদর্শকেরা অনেক বছর ধরে সংগ্রহ করা নমুনার জন্য কোনো বিল পাচ্ছেন না। অথচ গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত (মার্চ ও জুন বাদে) ঢাকা উত্তর সিটির স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে প্রতি মাসে ইমপ্রেস্টমানির পুরো টাকা তোলা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে তোলা হয়েছে বরাদ্দের দ্বিগুণ টাকা।
বেশির ভাগ ব্যয় খাবারে
ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তার দপ্তরের কয়েক মাসের ইমপ্রেস্টমানির বিস্তারিত বিল এসেছে প্রথম আলোর হাতে। এর মধ্যে মেয়র দপ্তরের গত বছরের ১১ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যয়ের বিবরণী আছে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান সমাজকল্যাণ কর্মকর্তার দপ্তরের গত ১০ মাসের (গত মে থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) ব্যয়ের বিবরণী পাওয়া গেছে। ব্যয়ের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বরাদ্দের বেশির ভাগ অর্থ ব্যয় হয় খাবারদাবার কিংবা আপ্যায়নের পেছনে।
প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন বিভাগের গত অক্টোবরে বরাদ্দের দ্বিগুণ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। দুই দফায় অক্টোবরে ওই দপ্তর থেকে ৯৯ হাজার ৮৯০ ও ৯৯ হাজার ৭৬২ টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে অক্টোবর মাসের ১৬ দিনের ব্যয়ের যে হিসাব পাওয়া গেছে, তাতে মোট ব্যয় হয়েছে ৯৯ হাজার ৮৪০ টাকা। এই সময়ে খাবারের পেছনে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ৭৬ হাজার টাকা। খাবারের মধ্যে রয়েছে ভাত-ভর্তা, পোলাও, বিরিয়ানি, তেহারি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফাস্ট ফুড, ফলমূল ও মিষ্টিজাতীয় খাবার। আর প্রায় ২৩ হাজার ৮৪০ টাকা অতিথিকে ফুল কিংবা উপহার দেওয়া বাবদ ব্যয় করা হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি ইমপ্রেস্টমানির যে নীতিমালা করেছে, তাতে অর্থ ব্যয়ের ১৫ নম্বর শর্তে বলা আছে, আপ্যায়ন বাবদ এই বরাদ্দের সর্বোচ্চ ২৫ ভাগ ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু ঢাকা উত্তর সিটির ওই ১৬ দিনের হিসেবে, ৭৬ ভাগের বেশি অর্থ আপ্যায়নের পেছনে ব্যয় করা হয়েছে।
গত নভেম্বরে মেয়রের দপ্তরে আপ্যায়নের পেছনে প্রায় ৭৮ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। এই সময়ে সাড়ে তিন শর বেশি অতিথিকে আপ্যায়ন করা হয়। তবে কী দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছে, তা বিস্তারিত উল্লেখ নেই।
জনগণের টাকা নয়ছয় করা অগ্রহণযোগ্য
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হলে ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এটা কীভাবে হলো, যাচাই করে দেখা হবে। পাশাপাশি এর যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সেটা দেখা হবে। কারণ, ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। ইমপ্রেস্টমানি ব্যয়ের নীতিমালা তৈরির উদ্দেশ্যে আগামী সপ্তাহে একটি সভা ডাকা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় সরকারি চাকরির বিধিবিধানের বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়ার। তিনি সংস্থাটির নিরীক্ষা বিভাগের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইমপ্রেস্টমানির টাকা তো আপ্যায়নের পেছনে এভাবে খরচের সুযোগ নেই। এটা গুরুতর অনিয়ম। জনস্বার্থজনিত কোনো কাজ যাতে ব্যাহত না হয়, দৈনন্দিন এমন জরুরি প্রয়োজন মেটাতে এ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। জনগণের অর্থ এভাবে নয়ছয় করাটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর জবাবদিহি নিশ্চিত করা দরকার।’