পান্থকুঞ্জে এখন আর গাছ তেমন নেই। ক্ষতবিক্ষত মাঠটি রক্ষার দাবিতে সেখানে ১০০ দিন ধরে অবস্থান করছেন বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা। শৈত্যপ্রবাহ, খরতাপ, চারপাশে সারাক্ষণ উচ্চ শব্দে গাড়ির হর্ন, মশার উৎপাত আর নানা মহলের চাপে তাঁরা শরীরে–মনে অনেকটাই অবসন্ন; কিন্তু মনোবলে অটুট। দাবিতে অনড়। আজ রোববার সকালে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁরা ঘোষণা দিলেন, হাতিরঝিল ও পান্থকুঞ্জ বিধ্বংসকারী জনবিরোধী এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প (সংযোগ সড়ক) প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। পান্থকুঞ্জ রক্ষায় অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে।
পান্থকুঞ্জ রক্ষায় গাছ রক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর থেকে সেখানে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। আজ ছিল তাদের অবস্থানের শততম দিন। এ উপলক্ষে আজ বেলা ১১টায় বাংলামোটরের বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে গাছ রক্ষা আন্দোলন জানিয়েছে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহম্মদ। তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, পরিবেশ–প্রকৃতি রক্ষার জন্য গাছ রক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা চরম বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যে ১০০ দিন ধরে অবস্থান করছেন। অথচ সরকারের কানে যাচ্ছে না গণমানুষের দাবি। এটা খুবই হতাশাজনক।
স্বৈরশাসনের অবসানের পরে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে আশা জেগেছিল তা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে মন্তব্য করে আনু মুহম্মদ বলেন, হাতিরঝিল ও পান্থকুঞ্জ রক্ষায় সরকারের ভূমিকা কী হবে অবিলম্বে তা স্পষ্ট করে জানাতে হবে। সরকার চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ নেবে, নাকি নিজের দেশের জনগণের পক্ষে থাকবে সেটা তাদের জানাতে হবে। এটা তাদের একটা পরীক্ষা। অনেক লম্বা সময় পেরিয়ে গেছে। এখন সরকারকে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে এই প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য–সংবলিত লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজীব। তিনি বলেন, অবস্থান কর্মসূচি শুরুর দশ দিন পরে অন্তর্বর্তী সরকারের তিনজন উপদেষ্টা এসে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দিয়েছিলেন। গণমাধ্যমে তাঁদের বক্তব্য বিস্তারিতভাবে প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু তারপর তাঁরা আর কোনো উদ্যোগ নেননি।
পান্থকুঞ্জ রক্ষায় ৯ দফা দাবি তুলে ধরেন আমিরুল রাজীব। উল্লেখযোগ্য দাবির মধ্যে রয়েছে অবিলম্বে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এফডিসি থাকে পলাশী পর্যন্ত র্যাম্প বাতিল করতে হবে। পরিবেশ ও জনবিরোধী ত্রুটিপূর্ণ এই প্রকল্পের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন করে বিচার করতে হবে। হাতিরঝিল ভরাট করে তৈরি করা পিলার অপসারণ করে হাতিরঝিলকে আবার খনন এবং পান্থকুঞ্জে পিলারের জন্য খনন করা গর্ত ভরাট করে বৃক্ষরোপণ করে ঝিল ও পার্ককে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। মাঠ, পার্ক, জলাধার রক্ষার বিদ্যমান আইন সংশোধন করে কঠোর বিধান প্রণয়ন করতে হবে। অতি ব্যয়বহুল ও বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্প গ্রহণের প্রবণতা থেকে রাষ্ট্রকে সরে আসতে হবে। সড়ক পরিবহন পরিকল্পনায় ব্যয়সাশ্রয়ী, টেকসই, গণপরিবহনকেন্দ্রিক ও পরিবেশ সহনশীল প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এই র্যাম্প নির্মাণের কাজ বাস্তবায়িত হলে কেবল পরিবেশই বিনষ্ট হবে না, ভবিষ্যতে এই এলাকায় গণপরিবহনের উন্নয়নের সম্ভাবনাও ধ্বংস হবে।
সেন্টার ফর ল অ্যান্ড পলিসি অ্যাফেয়ার্সের সম্পাদক আইনজীবী সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, উচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে হাতিরঝিলের পরিবেশ বিনষ্ট করা যাবে না। বিজেএমইএ ভবন সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হলো। আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে কীভাবে হাতিরঝিল ভরাট করা হলো? এ জন্য এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইন অমান্যের দায়ে অভিযুক্ত করে মামলা করা যায়। সেটাই করতে হবে।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা’র (ধরা) সদস্যসচিব শরীফ জামিল বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া এই প্রকল্প হচ্ছে। কিন্তু অধিদপ্তর কী করছে? গাছ কাটা হচ্ছে, বন বিভাগ কী করছে? এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
পরিবেশবিদ অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকা শহর ক্রমেই বসবাসযোগ্যতা হারাচ্ছে, এটা বারবার বলা সত্ত্বেও শহরের ফাঁকা জায়গাগুলোতে স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। বৃক্ষনিধন, জলাভূমি ভরাট–দখল চলছে। এসব চলতে থাকলে কোনোভাবেই শহরকে বসবাস উপযোগী করে তোলা যাবে না।
সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ প্রকৃতি–বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠন, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা বক্তব্য দেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজের (বারসিক) সৈয়দ আলি বিশ্বাস, পান্থকুঞ্জ প্রভাতির সম্পাদক সিরাজউদ্দিন তুহিন, মহিলা পরিষদের পারভিন ইসলাম, তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষা আন্দোলনের সৈয়দা রত্না, ওয়ার্ক ফর আ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের মো. মিথুন, আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন, সংগীতশিল্পী অরূপ রাহী, চলচ্চিত্র নির্মাতা আকরাম খান প্রমুখ।