১২ কিলোমিটার পথে ২৩ স্থানে যাত্রী তুলল বাসটি
বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে সমালোচনার মুখে ওয়েবিল প্রথা বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছিল ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। তারা বলেছিল, ঢাকা ও এর আশপাশের শহরতলির বাসে রাস্তায় কোনো পরিদর্শক (চেকার) থাকবে না। রুট পারমিটে বর্ণিত বাসস্ট্যান্ডের বাইরে থামিয়ে যাত্রী তোলা যাবে না।
এ ঘোষণা রাজধানীতে কার্যকর হতে দেখা যায়নি। বৃহস্পতিবারও যেখানে–সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হয়েছে। এক বাসস্ট্যান্ড থেকে অন্য বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত চলাচলের সময় বাসের দরজা বন্ধ রাখার নির্দেশনা থাকলেও পুরো যাত্রাপথে দরজা খোলা রেখে চলেছে বাস। ভাড়াও নেওয়া হয়েছে ইচ্ছেমতো। এক দিন আগেই বুধবার ওয়েবিল প্রথা বাতিল করার ওই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
গত সোমবার ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি এক বৈঠক করে ওয়েবিল প্রথা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। বুধবার এ–সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমে জানিয়ে বলা হয়, ওই দিন থেকেই তা কার্যকর হবে।
শিকড় পরিবহন নামের একটি বাসে করে বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেদক মিরপুর ১১ নম্বর সেকশন থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত যান। ১২ কিলোমিটারের এই যাত্রাপথে বাসটিকে অন্তত ২৩ স্থান থেকে যাত্রী তুলতে দেখা গেছে। আড়াই ঘণ্টার যাত্রার পুরো সময় বাসটির দরজা খোলা ছিল।
বিকেল পৌনে ৫টার দিকে মিরপুর ১১ নম্বরে নির্মাণাধীন মেট্রোরেলের স্টেশনের সামনে থেকে শিকড় পরিবহনের বাসে ওঠেন এই প্রতিবেদক। মিরপুর ১২ নম্বর থেকে আসা বাসটির গন্তব্য ছিল যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত। এই প্রতিবেদক যখন বাসে ওঠেন তখন ২৫টি আসনের মধ্যে ১৭টিতে যাত্রী ছিলেন। বাসে ওঠার পর ৩০ সেকেন্ডের মাথায় যাত্রী তুলতে বাসটি থেমে যায়। এরপর ২৫ সেকেন্ডের মধ্যে আবারও বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হয়। এভাবে মিরপুর ১১ থেকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত সোয়া এক কিলোমিটার পথে অন্তত ৮টি স্থান থেকে যাত্রী তুলেছে বাসটি।
এরপর ১০ নম্বর গোলচত্বর পেরিয়ে কাজীপাড়া মেট্রোরেলের স্টেশনের আগে, কাজীপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের উল্টো পাশেও বাসটি থেমে যাত্রী নিতে থাকে। এরই মধ্যে সব আসন পূর্ণ হয়ে বাসটিতে দাঁড়ানোর জায়গাটুকু অবশিষ্ট ছিল না।
কাজীপাড়া পেরিয়ে শেওড়াপাড়া যাওয়ার পথে যানজটে আটকা পড়ে বাসটি। সেখানে প্রায় ৪৫ মিনিট এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার পর বাসটি যখন সামনে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পায়, তখন শেওড়াপাড়া পেরিয়ে আবার যাত্রী তুলতে বাসটি দাঁড়ালে ভেতরের যাত্রীরা হট্টগোল শুরু করেন। তাঁদের কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, যানজটে পৌনে এক ঘণ্টা আটকে থাকার পর এক মিনিট বাস না এগোতেই কেন থামানো হলো? এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে বাসচালকের বাগ্বিতণ্ডা হয়।
বাসটি এগিয়ে চলার মধ্যে শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টো পাশ, তালতলা, আগারগাঁও বিমানবাহিনী জাদুঘরের সামনে, আগারগাঁও মোড়, চন্দ্রিমা উদ্যান ট্রাফিক বক্সের সামনে, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার মোড়ের দুই পাড়, বাংলামোটর, শাহবাগ, মৎস্য ভবন, প্রেসক্লাবের কর্নার ও সবশেষ জিরো পয়েন্ট থেকে যাত্রী তোলে বাসটি। জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত এ যাত্রায় বাসটিতে গাদাগাদি করে ছিলেন যাত্রীরা।
এদিকে কারওয়ান বাজার মোড় অতিক্রম করার পর সোনারগাঁও হোটেল পার হতে গেলে হাতের ইশারায় এক যুবক বাসটি থামানোর চেষ্টা করেন। পরে বাস কিছুটা গতি কমিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। পরে জানা যায়, একজন পরিদর্শক (চেকার) বাসটি থামানোর চেষ্টা করেছিলেন। তখন বাসচালকের সহযোগী ওই চেকারের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেন। এতে চেকার আর বাসে ওঠেননি। অবশ্য বাসে ঠাসাঠাসি করে এত যাত্রী তোলা হয়েছিল যে ওই সময় চাইলেও আর কারও বাসটিতে ওঠা সম্ভব ছিল না।
ঢাকা নগর ও শহরতলির বাস-মিনিবাসে ওয়েবিল প্রথা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এই ব্যবস্থায় একটি রুটে সাধারণত নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় বাসমালিকের নিয়োজিত লোকেরা পরিদর্শন বা চেক করেন। তাঁরা নির্দিষ্ট স্থানে বাস থামিয়ে কতজন যাত্রী আছেন, তা লিখে দেন। ফলে একজন যাত্রীকে বাসে উঠে পরের স্ট্যান্ডে নামতে গেলেও পরবর্তী ওয়েবিল লেখার স্থান পর্যন্ত ভাড়া গুনতে হয়। এভাবে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বাড়তি আদায় করে থাকেন পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা।
এ ছাড়া সিটিং সার্ভিস, গেটলক সার্ভিসের নামেও যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়। সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে ওয়েবিল প্রথা, সিটিং সার্ভিস, গেটলক সার্ভিস অবৈধ। বাড়তি ভাড়া আদায়ের দায়ে সংশ্লিষ্ট পরিবহন কোম্পানির বাস চলাচলের অনুমতি বাতিল করার বিধান আছে। কিন্তু সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় আইনের এই কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োগ করেনি।
এদিকে মিরপুর ১১ নম্বর থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১২ কিলোমিটারের এই পথে ৪০ টাকা ভাড়া দিয়েছেন এই প্রতিবেদক। এ দূরত্বে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) নির্ধারিত ভাড়া ৩০ টাকা (কিলোমিটার প্রতি ২ টাকা ৫০ পয়সা)। এই বাসে করে যাওয়া অন্য যাত্রীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ভাড়া নিতে দেখা গেছে। যেমন বাংলামোটর মোড় থেকে জিরো পয়েন্টে যেতে যাঁরা বাসটিতে উঠেছেন, তাঁদের ১৫ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়েছে। অথচ এই দূরত্বে (৩ দশমিক ২ কিলোমিটার) ভাড়া হওয়ার কথা ছিল ৮ টাকা। রাজধানীতে মিনিবাসের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ভাড়াও নির্ধারণ করা আছে ৮ টাকা।
বাড়তি ভাড়া আদায় করা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে মাহফুজুর রহমান নামের এক যাত্রী বাসটির চালকের সহযোগীকে বলেন, ভাড়ার নামে নৈরাজ্য বন্ধ কর। বাংলামোটর থেকে জিরো পয়েন্টের ভাড়া কীভাবে ১৫ টাকা হয়? তখন চালকের সহযোগী বলেন, সবকিছুর দাম বাড়তি। বেশি ভাড়া তো দিতেই হবে। ১৫ টাকা না দিলে বাস থেকে নেমে যান।
অথচ ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি জানিয়েছিল, পরিবাগে সংগঠনের গত সোমবারের বৈঠকে ১২০টি পরিবহন কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, প্রতিটি বাস সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা মেনে ভাড়া আদায় করবে। বাসের দৃশ্যমান স্থানে এ তালিকা টানাতে হবে। তবে বৃহস্পতিবার শিকড় পরিবহনের যে বাসটিতে এই প্রতিবেদক যাতায়াত করেছেন সেই বাসে (ঢাকা মেট্টো ব ১১-৩৩৩৫) ভাড়ার নতুন তালিকা টানাতে দেখা যায়নি।
ওয়েবিল প্রথা বাতিলসহ ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর না করার কারণ জানতে চাইলে বাসটির চালকের সহযোগী সজীব মিয়া বলেন, তাঁদের কোম্পানি এখনো ওয়াবিল প্রথা বাতিল করেনি। যখন করবে তখন তাঁরা এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করবেন। আর যেখানে–সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা ও বেশি ভাড়ার বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
পরিবহন মালিক সমিতির সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়া বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বৃহস্পতিবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিনের অনিয়ম নিয়মে আসতে তো সময়ের প্রয়োজন। বিআরটিএর ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ৯টি দল করা হয়েছে। এরা কাজ করছে। এটা আমরা কন্টিনিউ করব। যত দিন লাগে কন্টিনিউ করব।’