সরকারি বহুতল এই ভবনগুলো এখন বোঝা
অব্যবহৃত থাকায় কিছু ভবন দিন দিন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
ঢাকা জেলা পরিষদের ২০ তলা একটি ভবন সাত বছর ধরে খালি পড়ে রয়েছে। পুরান ঢাকার জনসন রোডের মোড়ে অবস্থিত এ বহুতল ভবনটি নির্মাণের সময় নিয়মনীতি মানা হয়নি। ২০১৬ সালে অনিয়ম ধরা পড়ার পর এর নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর পর থেকে ভবনটি অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে।
‘বিপুল ব্যয়ের ভবনটি খালি পড়ে আছে, নথি গায়েব’ শিরোনামে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। প্রতিবেদনটি প্রকাশের এক বছর পর ‘ঢাকা টাওয়ার’ নামে ওই ভবনের সর্বশেষ অবস্থা জানতে খোঁজ নেন এ প্রতিবেদক। দেখা গেল, এটি আগের মতোই খালি পড়ে আছে।
অব্যবহৃত থাকায় ভবনটি দিন দিন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এক বছরে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। ভবন নির্মাণসংক্রান্ত ফাইলের নথি এখনো পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি এর নকশাও।
সবার চোখের সামনে ২০ তলা ভবন হয়ে গেল। অথচ এর নকশা পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো নথি পাওয়া যাচ্ছে না। এটা কীভাবে সম্ভব?
ঢাকায় গত কয়েক বছরে ঢাকা টাওয়ারের মতো সরকারি বেশ কিছু বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ভবনের খালি পড়ে থাকা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে প্রথম আলো। প্রতিবেদন প্রকাশের পর এসব স্থাপনার অবস্থা এখন কী, সে ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, কিছু ভবন চালু হয়েছে। যেমন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবন, তথ্য কমিশন ভবন, ডাক ভবন, মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসন ভবন। তবে কিছু ভবন এখনো আগের মতোই খালি পড়ে আছে।
‘রহস্যময় কারণে ভবনটি চালু হচ্ছে না’
ঢাকা টাওয়ার নামের ভবনটি নির্মাণ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন। ভবনটি নির্মাণে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন নেয়নি ঢাকা জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এমনকি নকশাও পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা যাতে ধরা না পড়েন, সে জন্য সব ধরনের নথি গায়েব করে ফেলা হয়েছে। এসব অনিয়মের সঙ্গে কারা জড়িত, তাঁদের নাম প্রকাশ করছে না কেউ। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। আবার রহস্যময় কারণে ভবনটি চালুও করা হচ্ছে না। ফলে ১৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভবনটি এখন বোঝায় পরিণত হয়েছে। ভবনে দোকান ও জায়গা (স্পেস) ভাড়া নিতে যাঁরা টাকা বিনিয়োগ করেছেন, তাঁরা বিপাকে পড়েছেন।
ঢাকা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবার চোখের সামনে ২০ তলা ভবন হয়ে গেল। অথচ এর নকশা পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো নথি পাওয়া যাচ্ছে না। এটা কীভাবে সম্ভব?’ তিনি আরও বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে জানার চেষ্টা করছি কেন ভবনটি বন্ধ, মন্ত্রী-সচিব কিছুই বলছেন না।’
ঢাকায় গত কয়েক বছরে ঢাকা টাওয়ারের মতো সরকারি বেশ কিছু বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ভবনের খালি পড়ে থাকা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে প্রথম আলো।
জনবল পাওয়া যায়নি, ফাঁকা পড়ে ভবন
রাজধানীর বেইলি রোডে অফিসার্স ক্লাব-লাগোয়া ছয়তলা একটি দৃষ্টিনন্দন ভবন প্রায় পাঁচ বছর ধরে খালি পড়ে রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রদর্শনের পাশাপাশি তাঁদের বিভিন্ন উৎসব–পার্বণের আয়োজনে নির্মাণ করা হয়েছিল স্থাপনাটি। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ১৯৪ কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত কমপ্লেক্সটি পুরোপুরি চালু করা যাচ্ছে না জনবলের অভাবে।
তবে ভবনটি খালি পড়ে আছে—মানতে নারাজ পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের সচিব মশিউর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রয়োজন অনুসারে সেখানে সভা হয়।
সূত্র বলছে, ১৯৪ কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত কমপ্লেক্সটি পুরোপুরি চালু করা যাচ্ছে না জনবলের অভাবে।
কর্মকর্তারা যাবেন না, ভবন ভাড়া দেওয়া হচ্ছে
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে সচিবালয় থেকে সরিয়ে নিতে আগারগাঁওয়ে ১৩ তলা ভবনের কাজ শেষ হয় ২০২০ সালে। ২২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ‘জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমপ্লেক্সটি’ এখনো ফাঁকা। ১৬ অক্টোবর সরেজমিনে দেখা যায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়নি।
জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক মুনীর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ভবনে সরকারের কয়েকটি সংস্থাকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই তারা নতুন ভবনে উঠবে।
মিরপুর ৬ নম্বরের চলন্তিকা মোড়ে ১০টি বহুতল ভবন বানানো হয়েছে তিন বছর আগে। প্রতিটি ভবন ১৪ তলা। প্রতিটি ভবনে আছে ৭৮টি করে ফ্ল্যাট। তবে বেশির ভাগ ফ্ল্যাট এখনো খালি। ১৬ অক্টোবর গিয়ে দেখা যায়, ৮ নম্বর ভবনটি তিন বছর ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানের নির্মিত ভবনটিও খালি
সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনসুবিধার জন্য মিরপুর ৬ নম্বরের চলন্তিকা মোড়ে ১০টি বহুতল ভবন বানানো হয়েছে তিন বছর আগে। প্রতিটি ভবন ১৪ তলা। প্রতিটি ভবনে আছে ৭৮টি করে ফ্ল্যাট। তবে বেশির ভাগ ফ্ল্যাট এখনো খালি। ১৬ অক্টোবর গিয়ে দেখা যায়, ৮ নম্বর ভবনটি তিন বছর ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। কেউ সেখানে উঠছে না। ভবনটি নির্মাণ করেছে বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা আলোচিত ঠিকাদার জি কে শামীমের কোম্পানি জি কে বিল্ডার্স।
সরকারি ভবন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকার বিষয়ে সরকারি চাকরি বিধিবিধান বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘যে উদ্দেশ্যে এসব ভবন নির্মাণ করা হলো, তা যদি ব্যবহার না হয়, এটি অবশ্যই সরকারি টাকার অপচয়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিলে কর্মকর্তারা সেখানে যেতে বাধ্য। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না থাকায় কর্মকর্তারা সুযোগ পাচ্ছেন।’