কী কাজে ডাকে সিটি করপোরেশন, জানালেন দুই কীটতত্ত্ববিদ
রাজধানীতে মশা যখন মানুষের জীবন-মরণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে, তখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে কীটতত্ত্ববিদের পদ খালি। উত্তর সিটিতে অবশ্য একজন কীটতত্ত্ববিদ রয়েছেন।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশকনিধনে গবেষণার কাজ করেন কীটতত্ত্ববিদ বা মেডিকেল এন্টোমলজিস্টরা। তাঁরা মশা-মাছির গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন। কীটনাশকের মান পরীক্ষার কাজটিও করেন কীটতত্ত্ববিদেরা।
অবশ্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মশার ওষুধ ঠিক করে তার কাগুজে অনুমোদনের জন্য ডাকে বলে জানিয়েছেন দুজন কীটতত্ত্ববিদ। তাঁরা আরও বলেছেন, মশা মারার বিষয়ে দক্ষিণ সিটি তাঁদের কাছ থেকে কোনো পরামর্শ নেয় না।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের জনবলকাঠামোয় কীটতত্ত্ববিদের দুটি করে পদ রয়েছে—ঊর্ধ্বতন কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা ও কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা। নিয়ম হলো, ঊর্ধ্বতন কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা পদে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হবে। আর কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেবে সিটি করপোরেশন।
দক্ষিণ সিটি সূত্র জানায়, সেখানে কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা পদে এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। মাস ছয়েক আগে তিনি চাকরি ছেড়ে চলে যান।
কীটতত্ত্ববিদ না থাকলেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা ফজলে শামসুল কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর চাকরির বয়স ২৭ বছর। স্বাস্থ্য বিভাগে আরও অনেক কর্মকর্তা আছেন, যাঁদের চাকরির বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর। বিভাগের কর্মকর্তারা মিলে কীটতত্ত্ববিদের কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। তবে কীটতত্ত্ববিদ থাকলে ভালো হতো বলেও মনে করেন এই কর্মকর্তা।
অভিজ্ঞতা থেকে কীটতত্ত্ববিদের কাজ চালিয়ে নেওয়া গেলেও তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। একইভাবে একজন কীটতত্ত্ববিদের অভিজ্ঞতা থাকলেও তিনি মানুষের চিকিৎসা দিতে পারেন না। কারণ, তাঁর এ নিয়ে পড়াশোনা নেই। সনদও নেই।কবিরুল বাশার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ
ফজলে শামসুল কবির আরও বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে তাঁদের একটি কারিগরি কমিটি আছে। ওই কমিটির সদস্য ১৩ জন। এর মধ্যে ৯ জন কীটতত্ত্ববিদ আছেন। তাঁদের পরামর্শ নিয়ে মশকনিধনের কাজ করা হচ্ছে।
দক্ষিণ সিটির এই কর্মকর্তারা কতটা ভালোভাবে কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন, তা দেখা যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে। গতকাল শনিবার কন্ট্রোল রুমের পাঠানো ডেঙ্গু পরিস্থিতির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (গত শুক্রবার সকাল আটটা থেকে গতকাল শনিবার সকাল আটটা পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে আরও ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এই বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হলো ৮৯৩।
কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২ হাজার ৮৬৫ রোগী ঢাকাসহ সারা দেশের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৮২৪ জন ঢাকা শহরের ও ২ হাজার ৫১ জন ঢাকা শহরের বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে এই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭১৭ জন।
ঢাকা উত্তর সিটিতে কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার পদটি শূন্য। এই পদে এখনো কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম রেজা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি এক জরিপে জানায়, ঢাকায় বসতবাড়িতে এবার এডিস মশার শূককীট বা লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, অভিজ্ঞতা থেকে কীটতত্ত্ববিদের কাজ চালিয়ে নেওয়া গেলেও তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। একইভাবে একজন কীটতত্ত্ববিদের অভিজ্ঞতা থাকলেও তিনি মানুষের চিকিৎসা দিতে পারেন না। কারণ, তাঁর এ নিয়ে পড়াশোনা নেই। সনদও নেই।
ঢাকা উত্তর সিটিতে কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার পদটি শূন্য। এই পদে এখনো কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম রেজা। তিনি বলেন, তাদের ঊর্ধ্বতন কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা রয়েছে। কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা হিসেবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁরা বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চলে যান।
কারিগরি কমিটির কাজ কী
মশকনিধনে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি যে কারিগরি কমিটির কথা বলছে, ওই কমিটিতে দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তা আছেন তিনজন। এর মধ্যে দুজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। দুই কর্মকর্তার মধ্যে একজন সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি সরকারের অতিরিক্ত সচিব। আরেকজন দক্ষিণ সিটির প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা। তিনি একজন উপসচিব। বাকি একজন সংস্থার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দায়িত্ব আছেন।
১২ সদস্যের কারিগরি কমিটিতে ৫ সদস্যের নাম উল্লেখ নেই। এসব পদে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট পদে থাকা ব্যক্তিদের রাখা হয়েছে। যেমন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ও উপযুক্ত প্রতিনিধি, রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অথবা উপযুক্ত প্রতিনিধি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের পরিচালক বা উপযুক্ত প্রতিনিধি, আইসিডিডিআরবির পরিচালক বা প্রতিনিধি এবং ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা সরকারি পরিচালককে রাখা হয়েছে।
কারিগরি কমিটির বাকি তিনজন সদস্য হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ফিরোজ জামান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি মেম্বার ও মেডিকেল এন্টোমলজিস্ট জি এম সাইফুর রহমান।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠিত কারিগরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক কবিরুল বাশারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, এই কমিটির সর্বশেষ সভা কবে হয়েছিল এবং কমিটির কাজ কী? এ বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ সিটি কোন কীটনাশক ব্যবহার করবে, এটি কমিটির সভায় উপস্থাপন করে অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়। এর বাইরে এই কমিটির কোনো কার্যক্রম নেই। এই কমিটি কী ধরনের কাজ করবে, তা–ও সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই।
কাজ শুধু অনুমোদন
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠিত কমিটির সদস্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি মেম্বার ও কীটতত্ত্ববিদ জি এম সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশন সব ঠিক করে রাখে। কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে কেবল অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়। বছরে একবার এই কমিটির সভা হয় এবং সবশেষ মাস চারেক আগে সভা হয়েছে।
সাইফুর রহমান বলেন, এই কমিটির সভা নিয়মিত হলে পরিস্থিতির আলোকে অনেক পরিকল্পনা নেওয়া যেত।
মশকনিধনের পুরো বিষয় কীটতত্ত্ববিদের পরামর্শের আলোকেই হওয়া উচিত উল্লেখ করে সাইফুর রহমান বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা সভায় অনেক কথা বলেন। তাঁরা বলেন সব নিয়ন্ত্রণে আছে। আমরা সফল হয়েছি ইত্যাদি। কীটতত্ত্ববিদ করপোরেশনে কাজ করুক, এটা তাঁরা চান না।’