পুরান ঢাকার ‘চাঙাড়িওয়ালা’

কেরানীগঞ্জ থেকে আসা টিফিন বক্স পুরান ঢাকার গ্রাহকদের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন এক চাঙারিওয়ালা। বাবুবাজার ব্রিজ থেকে সম্প্রতি তোলাছবি: দীপু মালাকার

চুলা থেকে ভাত তুলে একটি বড় পাত্রে রাখা হয়েছে। ধোঁয়া উঠছে। সেখান থেকে ভাত তুলে টিফিন বাটিতে রাখছেন মোহাম্মদ আবুল হোসেন। পাশের কক্ষে একটি বড় কড়াইয়ে রান্না হয়েছে আলু দিয়ে পাঙাশ মাছের ঝোল। বেশ রং হয়েছে। নানা পদের সবজি দিয়ে একটা ভাজির পদ নামানো হয়েছে আগেই।

৭ ডিসেম্বর সময় তখন দুপুর সাড়ে ১২টা। স্থান পুরান ঢাকার লালবাগের হাজী রহিম বক্স লেন। জায়গাটি পোস্তা নামে পরিচিত। আবুল হোসেন ও তাঁর দলের হাতে সময় বেশি নেই। চারজনের দলের সবাই হাতে হাতে কাজ গুছিয়ে নিচ্ছেন। ৮০ জনের জন্য খাবার সাজাতে হবে। এরপর বেলা দেড়টার মধ্যে ভ্যানে করে এসব টিফিন বাটি পৌঁছে দিতে হবে নির্দিষ্ট জায়গায়।

আবুল হোসেনরা পরিচিত ‘চাঙারিওয়ালা’ নামে। তবে প্রকৃত চাঙারিওয়ালা দেখতে হলে যেতে হবে সোয়ারীঘাটে। চাঙারি বলতে বোঝায় বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি টুকরিজাতীয় একধরনের পাত্রকে। মূলত পুরান ঢাকায় এ পেশাজীবীরা কাজ করছেন ৬০ থেকে ৭০ বছর ধরে। পড়শি দেশ ভারতের মুম্বাই শহরে এঁরা পরিচিত ‘ডাব্বাওয়ালা’ নামে। শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে তাঁরা ছোটেন ডাব্বা (টিফিন বক্স) নিয়ে। সেখানে এই পেশার বয়স শত বছর। এখন ডাব্বাওয়ালারা ছড়িয়ে পড়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।

মূলত পুরান ঢাকায় যাঁরা বিভিন্ন দোকানে বা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, দুপুরের খাবারের বন্দোবস্ত করা তাঁদের জন্য বেশ চিন্তার। অনেকের পক্ষে সকালবেলা দুপুরের খাবার সঙ্গে নিয়ে বেরোনো সম্ভব হয় না। আবার অনেক ছোট বা মাঝারি প্রতিষ্ঠানে পৃথক ক্যানটিন নেই। সে ক্ষেত্রে রেস্তোরাঁয় আহার করাই বিকল্প। কিন্তু সেখানে খেতে খরচ বেশি। অনেকেই রোজ রেস্তোরাঁয় খাওয়াকে স্বাস্থ্যসম্মত মনে করেন না। উপায় হচ্ছে বাসার খাবার দোকানে আনিয়ে নেওয়া।

এখান থেকে চাঙারিওয়ালা পেশাটির উৎপত্তি। তাঁরা চাঙারিতে করে টিফিন বক্স নিয়ে এ দোকানে, সে দোকানে ছুটে বেড়ান। এভাবেই তাঁদের নাম হয়েছে চাঙারিওয়ালা। আবার খাওয়া শেষ হলে বাটি পৌঁছে দেন বাসায়। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা অবধি চলে এ কর্মযজ্ঞ।

ঢাকা গবেষক সাদ উর রহমান বলছিলেন, এই চাঙারিওয়ালাদের পেশাটা অনেক পুরোনো, অনেকটা ঢাকার ভিস্তিওয়ালাদের মতো। পাকিস্তান আমলে তাঁরা মূলত ঘরের তৈরি করা খাবার দুপুরে চকবাজারসহ ইসলামপুর, মিটফোর্ড, সদরঘাটের দোকান ও বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দিতেন। নব্বইয়ের দশক থেকে দেখা যায়, তাঁরা খাবার নিজেরা তৈরি করে দোকান ও প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন।

লালবাগের পোস্তার আবুল হোসেন বলছিলেন, তিনি ৮০ জনের খাবার সরবরাহ করেন। তাঁর ক্রেতারা সবাই পোশাককর্মী। সপ্তাহে চার দিন মাছ ও দুই দিন মাংস দেন, ভাজি বা ডাল থাকেই। ভাত পরিমাণমতো। এক বেলা খাবারের দাম ৫০ টাকা। তিন বেলাই খাবার সরবরাহ করেন তিনি। ক্রেতাদের কাছ থেকে সপ্তাহ ভিত্তিতে টাকা নেন। জিনিসপত্র কেনা, তাঁদের নিজেদের বেতনসহ সব খরচ বাদে মাসে সাত–আট হাজার টাকা থাকে।

সাম্প্রতিক সময়ে পুরান ঢাকার গ্রাহকদের খাবারের একটি অংশ আসে নদীর ওপার অর্থাৎ কেরানীগঞ্জ থেকে। প্রথম আলোর কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি ইকবাল হোসেন বলেন, জিঞ্জিরা, বরিশুর, বোরহানীবাগ, টিনের মসজিদ, কালিন্দি, মান্দাইলসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রলার আর খেয়ানৌকায় টিফিন বক্স নিয়ে চাঙারিওয়ালারা সোয়ারীঘাট, মিটফোর্ড ঘাট, ওয়াইজঘাট, সদরঘাটে পৌঁছে যান দুপুর ১২টা বাজতেই। একেকটি চাঙারিতে ৪০ থেকে ৫০টি টিফিন বক্স থাকে। ওজন হয় ৬০ থেকে ৮০ কেজি। চাঙারি নিয়ে কিছু পথ ভ্যানে, কিছু পথ মাথায় চাঙারিওয়ালারা ছোটেন চকবাজার, ইসলামপুর, মিটফোর্ড, বাবুবাজারে দোকানে, প্রতিষ্ঠানে। একজন ব্যবসায়ী বা দোকানকর্মীর কাছ থেকে একজন চাঙারিওয়ালা মাসে পান ৫০০ টাকার মতো।

পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি সালাউদ্দিন সোহেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের চকবাজার, মৌলভীবাজার এলাকায় কেরানীগঞ্জের বেশির ভাগ মানুষ ব্যবসা–বাণিজ্য ও কাজকর্মে জড়িত। এসব এলাকার লোকজন হোটেল-রেস্তোরাঁয় খেতে তেমন অভ্যস্ত নন। তাঁরা বাড়ির খাবার খেতে পছন্দ করেন। কিন্তু অনেক সময় সকালে গ্যাস থাকে না। আবার বহন করাও সমস্যা। তাই দুপুরের খাবার সঙ্গে করে আনতে পারেন না। চাঙারিওয়ালারাই বাসার রান্না করা গরম খাবার পৌঁছে দেন।

একজন চাঙারিওয়ালা বলছিলেন, তাঁদের পরিশ্রমের তুলনায় রোজগার কম। তবে কোনো কারণে যদি দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে, তাহলে তাঁদের রুজি বন্ধ হয়ে যায়।

পুরান ঢাকায় চাঙারিওয়ালার সংখ্যা কত, আর তাঁরা প্রতিদিন কত মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেন, এর কোনো সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না।

এই চাঙারিওয়ালারা এখন পুরান ঢাকার মুখ হয়ে উঠেছেন, এমনটা মনে করেন পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যবিষয়ক সংগঠন ঢাকা ফোরামের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহাম্মদ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, চাঙারিওয়ালারা একজন মানুষের ঘর ও কর্মস্থলের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করেন। তাঁর মতে, চাঙারিওয়ালাদের একটা সংগঠন থাকলে ভালো হতো।