দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারছেন না নিমতলীবাসী
পুরান ঢাকার নিমতলীর স্মৃতিস্তম্ভটি এখনো মনে করিয়ে দেয় সেই ১৪ বছর আগের ঘটনা। ২০১০ সালের ৩ জুন ৪৩ নবাব কাটরার পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় রাসায়নিকের গুদামে লাগা আগুন ছড়িয়ে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১২৪ জন। ভয়াবহ সেই আগুনে আশপাশের বাড়ি ও ভবনগুলো যে পুড়েছিল, এখন তা দেখে বোঝার উপায় নেই। মেরামত করে, পোড়া দাগ তুলে সেগুলোতে রং করা হয়েছে। দগ্ধ মানুষগুলোর শরীরের পোড়া ক্ষতও শুকিয়েছে কিন্তু দীর্ঘ এতটা সময়েও দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারছেন না তাঁরা ও স্বজন হারানো মানুষেরা।
নিমতলীর বাসিন্দারা বলেন, পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় (২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি) আগুন লাগার ঘটনায় মামলায় ভবনমালিক গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কিন্তু নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদাম রাখা ভবনমালিকদের কোনো জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি করা হয়নি। তাঁদের (স্থানীয় বাসিন্দা) দাবি একটাই, শতাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করে দায়ী ব্যক্তিদের সুষ্ঠু বিচার।
আমার সাত বছরের ছেলে বৈশাখ (কাওছার হোসেন) চোখের সামনে আগুনের গোলায় পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল। বেঁচে থাকলে এখন বয়স ২১ বছর হতো। আমরা সহযোগিতা পেতাম।মামুন মিয়া, ফলের দোকানি
গত শনিবার সকালে নিমতলী গিয়ে দেখা যায়, কর্মচঞ্চল মানুষ। দোকানপাট ও অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ব্যস্ততা। আগুনের সূত্রপাত হওয়া বিধ্বস্ত পাঁচতলা সেই ভবন মেরামত করে একতলা বাড়িয়ে ছয়তলা করা হয়েছে। বাড়ির মালিকেরা এখন এ ভবনেই থাকেন।
ওই ভবন ঘেঁষে পশ্চিম পাশে নিহত ব্যক্তিদের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভের উল্টো দিকে বিধ্বস্ত হওয়া দোতলা বাড়িটিও মেরামত করা হয়েছে। আগুনে ওই বাড়ির বাসিন্দা ফরিদউদ্দিনসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়। বেঁচে যাওয়া ফরিদউদ্দিনের তিন ছেলে পাশের এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যান্য বাড়িঘরও মেরামত করা হয়েছে। সেসবের কোনো কোনোটিতে তোলা হয়েছে বাড়তি তলা ও ঘর। তৈরি করা হয়েছে দোকান।
স্মৃতিস্তম্ভের ওপর ও পাশের একটি বাড়ির সামনে ব্যানার সাঁটানো দেখা যায়। তাতে লেখা, ‘৩ জুন নিমতলী ট্র্যাজেডি দিবস। ৩ জুনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মর্মান্তিকভাবে নিহত ১২৪ নারী-পুরুষ ও শিশুর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। শোকান্তে হাজী মো. সোলায়মান সেলিম এমপি, মাননীয় সংসদ সদস্য, ঢাকা-৭ আসন, হাজী মো. আউয়াল হোসেন কাউন্সিলর, ৩৩ নং ওয়ার্ড ঢাকা সিটি করপোরেশন। নবাব কাটারা সমাজকল্যাণ সংগঠন ও পঞ্চায়েত।’
স্মৃতিস্তম্ভের পশ্চিমে মামুন মিয়ার ফলের দোকান। সেদিনের স্মৃতিচারণা করে দোকানের ভেতর টানানো ছবি দেখিয়ে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার সাত বছরের ছেলে বৈশাখ (কাওছার হোসেন) চোখের সামনে আগুনের গোলায় পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল। বেঁচে থাকলে এখন বয়স ২১ বছর হতো। আমরা সহযোগিতা পেতাম।’ বৈশাখ মারা যাওয়ার পর মামুন মিয়ার আরেক সন্তান হয়েছে। নাম রাখা হয়েছে শ্রাবণ। পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে।
মামুন মিয়া বলেন, সেদিন তাঁর হাত, কান, মাথাসহ শরীরের ডান পাশটা পুড়ে গিয়েছিল। ক্ষত শুকিয়ে গেলেও চুলকানি হয়। চুলকানি সহজে বন্ধ হয় না। সেই দিনের দুঃসহ স্মৃতি এখনো ভুলতে পারছেন না তিনি।
রাসায়নিকের গুদামের পাশে মুদিদোকানে পুড়ে মারা যান দোকানদার মো. শফিকের ভাই আবদুর রহিম ও পণ্য কিনতে আসা দুই নারী। পুড়ে ছাই হয়ে যায় দোকানটিও। একই ভবনে থাকা আবদুর রহিমের দুই মেয়েও মারা গেছে সেদিন। কিছুদিন আগে অসুস্থ হয়ে শফিক মারা গেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর আজকের এ দিনে নিমতলীবাসী হারানো স্বজনদের কথা মনে করে কাঁদেন। আপনজনের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দিনব্যাপী দোয়া মাহফিল আয়োজন করেন। রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দেন।
দায়ী ব্যক্তিদের বিচার অনিশ্চিত
নিমতলীর ঘটনার সূত্রপাত ৪৩ নবাব কাটারার বাসিন্দা গুলজার আলীর পাঁচতলা বাড়ির নিচতলায় রাসায়নিকের গুদামে লাগা আগুন থেকে। তা মুহূর্তে প্রায় আধা কিলোমিটারজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দগ্ধ হয়ে ১২৪ জন মারা যান। দগ্ধ হন আরও কয়েক শ মানুষ। কিন্তু এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। শাস্তিও হয়নি কারও। তবে বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছিল।
১৪ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটাই দাবি ছিল, ঘটনার সুষ্ঠু বিচার, কিন্তু সেটা পাননি জানিয়ে ফলের দোকানি মামুন মিয়া বললেন, ‘সেদিনের ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নিমতলী ছেড়ে চলে গেছেন।’
নিমতলীর ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হলো কি না, সে বিষয়ে শনিবার বিকেলে যোগাযোগ করা হলে বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই ঘটনায় হওয়া জিডির সূত্র ধরে তখন ১২৪ জনের মরদেহ ঢাকা জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করতে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। এরপর জিডির আর তদন্ত হয়নি।’
রাসায়নিকের গুদামের কী অবস্থা
নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ৯ বছরের মাথায় চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন মারা যান। নিমতলীর ঘটনার পরপরই পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরানোর দাবি উঠেছিল। তখন রাসায়নিকপল্লি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদন হতেই প্রায় ৯ বছর পেরিয়ে যায়। এর মধ্যেই চুড়িহাট্টায় ‘ওয়াহেদ ম্যানশন’ ভবনে থাকা রাসায়নিকের গুদামে অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
এরপর আরও কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যু ও দুর্ভোগের কারণ পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরাতে না পারা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য, পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের ঝুঁকি এখনো রয়েই গেছে। এ জন্য দায়ী সুশাসনের ঘাটতি, জবাবদিহির অভাব ও জীবনরক্ষার প্রকল্পে অগ্রাধিকার না দেওয়া।
চুড়িহাট্টার ঘটনার পর শিল্প মন্ত্রণালয় রাসায়নিকের কিছু গুদাম টঙ্গীর কাঁঠালদিয়া ও ঢাকার শ্যামপুরের বন্ধ হয়ে যাওয়া উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জমিতে সরানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু তাতেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।