‘৬ মাসের ভাগনেকে বুকে জড়িয়ে লাফ দিই, পেছনে দেখি বোন নেই’
‘কেউ একজন পেছন থেকে বলল, আগুন লেগেছে। মুহূর্তে দাউ দাউ আগুন, কালো ধোঁয়া। আমি আরফানকে এক হাতে বুকে জড়িয়ে ধরি। আরেক হাত দিয়ে ছোট ছেলেকে ধরে ট্রেনের দরজা দিয়ে লাফ দিই। ঠিক পেছনেই ছিল বোন (এলিনা ইয়াসমিন)। নামার পর পেছনে তাকিয়ে দেখি ও নেই।’ হাসপাতালের শয্যায় চিকিৎসাধীন বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী ডেইজি আকতার হাহাকার নিয়ে কথাগুলো প্রথম আলোর প্রতিবেদককে বলছিলেন।
ডেইজির শ্বাসনালি কিছুটা পুড়ে গেছে। তিনি এখন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ৫২০ নম্বর কক্ষে চিকিৎসাধীন। শনিবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে তিনি শৌচাগারে যাওয়ার জন্য কক্ষ থেকে বের হয়েছিলেন। ওই সময় কক্ষের সামনে অপেক্ষারত স্বজন ও এই প্রতিবেদকের সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য কথা বলেন তিনি।
গতকাল শুক্রবার যশোরের বেনাপোল থেকে যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি ঢাকায় আসছিল। কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছানোর অল্প কিছুক্ষণ আগে রাত ৯টার দিকে গোপীবাগ কাঁচাবাজারের সামনে ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়। এতে তিনটি কোচ পুড়ে যায়। এখন পর্যন্ত চারজনের লাশ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে কারও পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পুড়ে যাওয়া তিনটি কোচের একটি ‘চ’তে ছিলেন ডেইজি, তাঁর স্বামী সাউথইস্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. ইকবাল বাহার খান, দুই ছেলে আরহাম ইউসুফ খান (১০) ও রাইয়ান ইউসুফ খান (৭), মামাতো বোন (নিখোঁজ) এলিনা ইয়াসমিন ও তাঁর ছয় মাসের ছেলে সৈয়দ আরফান হোসেন। ট্রেনে আরফান ছিল খালা ডেইজির কোলে।
ডেইজি জানান, আগুন লাগার পর তাঁর বড় ছেলে ট্রেনের এক আসন থেকে আরেক আসনে লাফিয়ে লাফিয়ে দরজার কাছে পৌঁছায়। তিনি আরফানকে বুকে জড়িয়ে ও ছোট ছেলেকে হাতে নিয়ে দরজার কাছে যান। ঠিক পেছনেই ছিলেন এলিনা। তাঁরা একসঙ্গে সবাই ছিলেন। তাঁরা দরজা দিয়ে আর তাঁর স্বামী জানালা দিয়ে লাফিয়ে নামেন। নামার পর এলিনাকে না পেয়ে তাঁরা এদিক–ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। ওই সময় আশপাশের সব লোক আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন। অনেকক্ষণ ছুটেও কোথাও এলিনাকে খুঁজে পাননি তাঁরা।
আগুনে ডেইজির স্বামী ও দুই সন্তানের শ্বাসনালি পুড়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। আর ছয় মাসের আরফানকে রুটিন পরীক্ষা করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সে সুস্থ আছে।
এলিনা স্বামী ও সন্তান নিয়ে রাজধানীর মিরপুরের ৬০ ফুট রোডের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। তাঁর ভাগনি তাসলিমা আফরোজ প্রথম আলোকে জানান, গত ২৭ ডিসেম্বর এলিনার বাবা সাইদুর রহমান মারা যান। সে উপলক্ষে তিনি রাজবাড়ীতে গ্রামের বাড়িতে যান। গতকাল ঢাকায় ফিরছিলেন।
হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের জন্য নির্ধারিত অপেক্ষা করার জায়গায় বসেছিলেন এলিনার ফুফু শাহনাজ পারভীন। তিনি বলছিলেন, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে চাইছেন, এলিনা বেঁচে আছেন।
‘ও হয়তো ব্যাগটাই আনতে গিয়েছিল’
ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের সামনে শিশু আরফানকে কোলে নিয়ে বসে নীরবে কাঁদছিলেন তার ফুফু ও খালা। পাশে বসে আহাজারি করছিলেন এলিনার স্বামী সাজ্জাদ হোসেন। স্বজনেরা জানান, দীর্ঘ চিকিৎসায় বিয়ের পাঁচ বছর পর আরফানের জন্ম হয়। ছেলের হৃদ্যন্ত্রে ছিদ্র আছে। তাই চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছিলেন এলিনা ও সাজ্জাদ। ছেলেকে নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ও সচেতন থাকতেন এলিনা।
এলিনার স্বামী সাজ্জাদ হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, তিনি স্ত্রী–সন্তানকে আনার জন্য গতকাল রাত পৌনে ৯টায় কমলাপুর স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। এলিনার মুঠোফোনে কল দেওয়ার পর এলিনা বলেছিলেন, ‘চপল (সাজ্জাদের ডাক নাম) আমি...।’ এরপর লাইনটি কেটে যায়। তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগে এক ব্যক্তি তাঁকে বলেন, ‘আপনি খবর পাননি! ট্রেনে তো আগুন লেগেছে। গোপীবাগে যান।’
সাজ্জাদ বলেন, পাসপোর্ট হয়েছে। ভিসার জন্য ছেলের মেডিকেলের কাগজপত্র তৈরি করছিলেন। ট্রেনে এলিনার কাছে থাকা ব্যাগে ছেলের চিকিৎসার অনেক কাগজপত্র ছিল।’ ডুকরে কেঁদে উঠে সাজ্জাদ বলেন, ‘ও হয়তো ব্যাগটাই আনতে গিয়েছিল। এ কারণে ট্রেন থেকে নামতে পারেনি।’ তিনি জানান, তাঁর স্ত্রীকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না। মর্গে যে চারটি লাশ রয়েছে, সেটা এতটাই পোড়া যে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। লাশ শনাক্তের জন্য তিনি ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন করবেন।
জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন মো. তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শিশু আরফান সুস্থ আছে। শিশুটির বাকি চার স্বজনের শ্বাসনালি পুড়েছে। তাঁদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তাঁদের জীবনশঙ্কা না থাকলেও তাঁরা বেশ অসুস্থ। তাই হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।