ঢাকায় ৬ ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি, ডুবল কোন কোন রাস্তা

ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে বৃষ্টিতে ডুবেছে রাস্তা। আটকে গেছে বাস। ঠেলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন কয়েকজন। দুপুর ১২টাছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

মুষলধারার বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রাস্তা ডুবে গেছে। আজ শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীসহ বেশির ভাগ চাকুরে নাগরিকদের ঘর ছাড়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে জীবিকা ও অন্যান্য অনিবার্য প্রয়োজনে যাঁরা পথে নেমেছেন, তাঁরা প্রচণ্ড দুর্ভোগে পড়েছেন।

রাস্তাগুলো জলমগ্ন হওয়ায় অনেক এলাকায় যানবাহন চলছে ধীরগতিতে। কোনো কোনো এলাকায় যান চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। জলমগ্নতার ফলে মহানগরজুড়ে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। নগরবাসীর পড়েছেন প্রচণ্ড দুর্ভোগে।

ঢাকার চাঁনখারপুলের শহীদুল্লাহ হলসংলগ্ন সড়কের রাস্তা তলিয়েছে পানিতে। মানুষের কষ্টের শেষ নেই। বেলা সাড়ে ১১টা
ছবি: দীপু মালাকার

আজ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় ৬ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ১৩০ মিলিমিটার। আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, এটা চলতি বর্ষা মৌসুমের স্বাভাবিক অবস্থায় রাজধানীতে এক দিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টি। এখন বৃষ্টির বেগ কমে এলেও পুরোপুরি থামেনি। অনেক এলাকায় এখনো বর্ষণ হচ্ছে। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় গত ২৭ মে রাজধানীতে এক দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছিল ২২৪ মিলিমিটার। সেটি মৌসুমের স্বাভাবিক বৃষ্টি নয়, তা ছিল ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবজনিত বৃষ্টি।

প্রচণ্ড বৃষ্টিতে রাজধানী বহু এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ায় অনেক সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে ফকিরেরপুল, নয়াপল্টন, বায়তুল মোকাররম, তোপখানা রোড, মৎস্য ভবন, কারওয়ান বাজার, শান্তিনগর, মালিবাগ মোড়, আরামবাগ, প্রগতি সরণি, নিউমার্কেট, ধানমন্ডির রাপা প্লাজা, মিরপুরের রোকেয়া সরণি, পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জ মোড়, বংশাল, নিমতলীর টোয়েনবি সার্কুলার রোড জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।

পানিতে ডুবে গেছে রাস্তা। সকাল আটটার দিকে
ছবি: ফাতেমা তুজ জোহরা

আবহাওয়া বিভাগের আবহাওয়াবিদ মো. তরিফুল নেওয়াজ কবির প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, নিয়ম অনুসারে প্রতি তিন ঘণ্টা পরপর বৃষ্টি পরিমাপ করা হয়। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৬০ মিলিমিটার। পরের তিন ঘণ্টায় পরিমাণ আরও বেড়েছে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৭০ মিলিমিটার। সব মিলে ৬ ঘণ্টায় বৃষ্টির পরিমাণ রেকর্ড ১৩০ মিলিমিটার।

সারা ঢাকাতেই আজ ভোর থেকে মৌসুমের স্বাভাবিক ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়াবিদ মো. তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, আজ বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। থেকে থেকে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি ঝরতেই থাকবে রাজধানীজুড়ে।

ধোলাইখালে এভাবেই ভ্যানে চড়ে পানি পার হচ্ছেন পথচারীরা। সকাল সাড়ে ১০টা
ছবি: দীপু মালাকার

আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রাজধানীসহ প্রায় সারা দেশেই বৃষ্টি হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে কক্সবাজারে ৩০৯ মিলিমিটার। এ ছাড়া সন্দ্বীপে বৃষ্টি হয়েছে ২১৯ মিলিমিটার, সীতাকুণ্ডে ১০২ মিলিমিটার।

আবহাওয়া অফিস জানায়, মৌসুমি বায়ু এখন অতিমাত্রায় সক্রিয় থাকার কারণেই এই ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এই মৌসুমি বায়ুর অক্ষ ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ এবং ভারতের আসাম হয়ে উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি বায়ু অতিমাত্রায় সক্রিয় থাকায় উপকূলীয় এলাকায় অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছে। দেশের ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে চলেছে।

আরও পড়ুন

মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তা আরও অন্তত তিন থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত থাকবে। তবে আগামীকাল শনিবার থেকে অতিমাত্রার সক্রিয়তা কমে আসবে। এর ফলে কাল থেকে মাঝেমধ্যে হালকা আবার মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হলেও এমন ভারী বর্ষণ হবে না বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে।

রাজধানীর মগবাজার এলাকায় রাস্তায় এমন পানি জমেছে বৃষ্টিতে। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে, মগবাজার, ঢাকা
ছবি: ফাতেমা তুজ জোহরা

রাজধানীর যেসব এলাকায় রাস্তায় পানি জমেছে দেখে নেওয়া যাক একনজরে:

পুরান ঢাকা: পুরান ঢাকায় পানি জমেছে সবচেয়ে বেশি। নাজিরাবাজার ও কাজী আলাউদ্দিন রোডে হাঁটুপানি। বংশাল রোড, লক্ষ্মীবাজার, তাঁতীবাজার নবাবপুর রোডে বয়ে যাচ্ছে ঘোলাপানির স্রোত। তুলনামূলকভাবে একটু উঁচু ধোলাইখাল রোডটিও আজ সকাল থেকে অতিবৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে।

লোকজনের দুর্ভোগ প্রচণ্ড। এখানে অনেক রিকশা চলে ব্যাটারিতে। কোনো কোনো সড়কে রিকশার পাদানির ওপর পানি ওঠায় রিকশার মোটর বন্ধ হয়ে গেছে। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়া রিকশাগুলো জলমগ্ন সড়ক দিয়ে টেনে নিতে দেখা যাচ্ছে চালকদের। এ ছাড়া নবাবপুর, বংশাল, ইসলামপুর এলাকায় অনেক সিএনজিচালিত অটোরিকশার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে থেমে গেছে।

বিশেষ করে নিমতলী, চাঁনখারপুল এলাকা জলমগ্ন হওয়ায় মেয়র হানিফ উড়াল সড়কের ওঠানামার মুখে লম্বা যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। পানি জমে থাকায় ফ্লাইওভারে ওঠার সময় যানবাহন এগোতে পারছে না। নামার সময়ও ধীরগতি।  

হাজারীবাগ: পুরান ঢাকায় পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা খুবই খারাপ। ড্রেন ও সুয়ারেজ লাইনগুলো থেকে ময়লা পরিষ্কার না করায় বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে যেতে পারে না। একই অবস্থা দেখা গেছে হাজারীবাগ মোড় থেকে ট্যানারি মোড়ের দিকের সড়কে। হাজারীবাগ নতুন রাস্তাটির কাঁচাবাজার মোড় থেকে উত্তর দিকে সিঙ্গারের তিন রাস্তার মোড় পর্যন্ত পুরোটাই হাঁটুপানিতে তলিয়ে গেছে। জুমার নামাজ আদায় করতে যেতে প্রচণ্ড অসুবিধায় পড়তে হয়েছে মুসল্লিদের।

গ্রিনরোডে জমেছে এমন পানি। সেই পানি মাড়িয়ে এভাবেই যাচ্ছেন এক নারী। বেলা সাড়ে ১১টা
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

গ্রিনরোড: প্রায় পুরো গ্রিনরোডে পানি জমেছে। কমফোর্ট হাসপাতাল থেকে গ্রিন লাইফ হাসপাতাল পর্যন্ত সড়ক পানিতে ডুবে গেছে। এখানে হাসপাতালগুলোতে রোগী নিয়ে যাতায়াত করতে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে লোকজনের। পানি জমেছে সেন্ট্রাল রোড ও কলাবাগান এলাকায়। বিশেষ করে কলাবাগানের আবেদ আলী ঢাল এলাকায় এত পানি জমেছে যে অনেক বাড়ির নিচতলা ও সড়কসংলগ্ন অনেক দোকানের ভেতরে পানি ঢুকেছে।

রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে জমেছে পানি। অনেক দোকানের ভেতর পানি ঢুকে গেছে। দুপুর ১২টা
ছবি: সামছুর রহমান

এলিফ্যান্ট রোড ও নিউমার্কেট : কাঁটাবন মোড় থেকে বাটার মোড় হয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় পর্যন্ত এলিফ্যান্ট রোডে পানি জমেছে। ওদিকে নিউমার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট হয়ে নীলক্ষেত অবধি সড়কে পানি জমেছে। পানি জমেছে আজিমপুর এলাকাতেও।

কল্যাণপুর: সকাল থেকে শুরু হওয়া মুষলধারার বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে কল্যাণপুর প্রধান সড়ক। বেলা পৌনে ১১টায় দেখা যায়, কল্যাণপুর নতুন বাজার মোড় থেকে কল্যাণপুর গার্লস স্কুল পর্যন্ত আধা কিলোমিটার সড়ক পুরো পানির নিচে ডুবে আছে। রিকশার পাদানিতে পানি উঠে যাচ্ছে। পথচলতি মানুষের হাঁটু ডুবে যাচ্ছে। রিকশাচালক বেলাল হোসেন বলেন, আর কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলে এই রাস্তায় রিকশা চালানোরও উপায় থাকবে না৷ পানির মধ্যে রিকশা সামনে এগোতে চায় না, অনেক দম লাগে। এই পানি পার হওয়ার জন্য যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ২০ টাকা করে নিচ্ছেন তিনি৷

ঢাকার ধানমন্ডি সীমান্ত স্কয়ারের সামনের রাস্তা এটি। বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে পুরো রাস্তা। বেলা ১১টা ৫৫ মিনিট
ছবি: সামছুর রহমান

ধানমন্ডি: ধানমন্ডি এলাকার সোবহানবাগ থেকে রাপা প্লাজার সামনে ২৭ নম্বর সড়কের বেশ খানিকটা হয়ে আসাদগেট মোড় পর্যন্ত এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। আসাদ গেট থেকে রাপা প্লাজা পর্যন্ত সড়কে বহু বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা আটকে পড়েছে। ফলে এই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

সকাল থেকে টানা বৃষ্টিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ রাস্তায় এমন পানি জমেছে। দেখে বোঝার উপায় নেই রাস্তা না নদী। বেলা ১১টা ৩৫ মিনিট
ছবি: সামছুর রহমান

মানিকমিয়া অ্যাভিনিউ: টিঅ্যান্ডটি স্কুলের সামনে থেকে পশ্চিম দিকের আড়ং মোড় পর্যন্ত পুরো সড়ক জলমগ্ন হয়ে আছে। এই সড়কে অনেক যানবাহন আটকে গেছে।  

মিরপুরের টোলারবাগের রাস্তা। পানির মধ্যে চলছে বাস। সকাল সাড়ে ১০টা
ছবি: আশরাফুল আলম

মিরপুর: মিরপুরের বেশির ভাগ এলাকার সড়কেই পানি জমেছে। রোকেয়া সরণি থেকে আগারগাঁও পার হয়ে শেওড়াপাড়া পর্যন্ত সড়কে পানি নেই। এর পর থেকে কাজীপাড়া সেনপাড়া ১০ নম্বর গোলচত্বর হয়ে সামনের দিকের পুরো সড়কটি জলমগ্ন হয়ে আছে। পানি ঢুকেছে সড়কের দুই পাশের মহল্লাগুলোর ভেতরের সড়কেও।

মিরপুরের কাজীপাড়ায় রাস্তায় হাঁটুসমান পানি। নোংরা পানি পেরিয়ে যাচ্ছেন এক নারী। বেলা ১১টা
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

টোলারবাগ: মিরপুর বাংলা কলেজের সামনে থেকে ১ নম্বর মোড় পর্যন্ত সড়কে পানি জমেছে। বিশেষ করে সড়ক ও জনপথ অফিস থেকে বাঙলা কলেজ পর্যন্ত সড়কে প্রায় হাঁটুপানি। এই সড়কের পশ্চিম দিকে টোলারবাগ এলাকার পশ্চিম প্রান্ত পুরোটাই জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। লোকজন ঘর থেকে বের হতে পারছেন না।

প্রেসক্লাব চত্বর : পানি জমেছে পুরো সেগুনবাগিচা এলাকায়। মৎস্য ভবন থেকে কদমফুল ফোয়ারা হয়ে তোপখানা রোড জলমগ্ন। জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বর পানিতে ডুবে গেছে।

আরও পড়ুন