সিদ্দিকবাজারের ভবনটির বেজমেন্টে বাণিজ্যিক গ্যাসলাইন ছিল, যা অবৈধ

সিদ্দিকবাজারের ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের বোমা নিস্ক্রিয়করণ দল সরেজমিন পরিদর্শন ও সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তাদের মতামত তুলে ধরেছে। আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে সেই মতামত সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে।

বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

সিদ্দিকবাজারের সেই ভবনটির বেজমেন্টের রান্নাঘরে একসময় বাণিজ্যিক বড় লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হতো, যা পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে বাড়ির অন্যান্য তলায় আবাসিক লাইন এখনো চলমান। বাণিজ্যিক লাইন সম্পূর্ণ বন্ধ না হয়ে সেখান দিয়েও তিতাস গ্যাস লিক হতে পারে। কোনোভাবে জমা গ্যাসে স্পার্কের মাধ্যমে বিস্ফোরণ হতে পারে। ভবনটির বেজমেন্টে কার পার্কিং থাকলে বাতাসের ভেন্টিলেশন থাকত। কোনো গ্যাসের জমা হতো না। বিস্ফোরণ ও হয়তো হতো না। তবে এখন পর্যন্ত সেখানে বিস্ফোরক বা অন্তর্ঘাতের কোনো আলামত সেখানে পাওয়া যায়নি।

পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল সরেজমিন পরিদর্শন ও সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এই মতামত তুলে ধরেছে। আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে তা সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে।

বেজমেন্টে গ্যাস–সংযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাস গ্যাসের পরিচালক (অপস.) সেলিম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো ভবনের বেজমেন্টে বৈধভাবে তিতাসের সংযোগ থাকার কথা নয়। যদি সেখানে সংযোগ পাওয়া যায়, তাহলে তিতাস দল পাঠাবে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।’

কোনো ভবনের বেজমেন্টে বৈধভাবে তিতাসের সংযোগ থাকার কথা নয়। যদি সেখানে সংযোগ পাওয়া যায়, তাহলে তিতাস দল পাঠাবে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।
সেলিম মিয়া, পরিচালক, তিতাস গ্যাস

ভবনটির সাধারণ তথ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ভবনটির নাম কুইন স্যানিটারি মার্কেট। একসময় এটার নাম ছিল কুইন ক্যাফে। ১০ তলা ভবনের পরিকল্পনা করা হলেও ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বেজমেন্ট ও একতলা সম্পূর্ণ করা ছিল। এর বেজমেন্টে ছিল রান্নাঘর আর একতলায় ছিল খাবারের হোটেল। এই রান্নাঘরে বাণিজ্যিক গ্যাসের বড় লাইন ছিল, যা পরে লিখিতভাবে তিতাসের কাছে সারেন্ডার করা হয়। ২০০৪ সালে ভবনটির সাততলা পর্যন্ত  সম্পূর্ণ করা হয়। বর্তমানে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড বেজমেন্টসহ সাততলা পর্যন্ত ভবনটি করা আছে। ভবনটির প্রকৃত মালিক প্রয়াত রেজাউর রহমান। ২০১১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তিন ছেলে, দুই মেয়ে এবং স্ত্রী বর্তমানে ভবনটির মালিক।

পর্যবেক্ষণ অংশে বলা হয়েছে, ভবনটির বেজমেন্টে পার্কিংয়ের কথা থাকলেও সেখানে একসময় রান্না ঘর ছিল। বর্তমানে ‘বাংলাদেশ স্যানিটারি’ নামের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে স্যানিটারি মালামাল বিক্রি করা হয় প্রায় ১৮০০ বর্গফুটের এ আন্ডারগ্রাউন্ডে, যা সম্পূর্ণটাই কাচঘেরা। বড় দুটি শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে (এসি) ঠান্ডা করা হয় এই স্যানিটারি দোকান। এ আন্ডারগ্রাউন্ডে আরও আছে একটি বড় পানির ট্যাংক। সাততলা ভবনের কোথায় সুয়ারেজ সেপটিক ট্যাংক, তা ভবনের মালিকেরা নিশ্চিত নন। ধারণা করা হয়, উত্তর পাশের ভবনের সঙ্গে এ ভবনের যে আড়াই বা তিন ফুট গলি আছে, সেখানেই দুই ভবনের সেপটিক ট্যাংক অবস্থিত।

ভবনটি কোনো পরিত্যক্ত পাবলিক স্পেস/ভবন নয়। ব্যক্তিমালিকানাধীন। বিভিন্ন ব্যবসায়ির সার্বক্ষণিক নজরদারি ও সিসি ক্যামেরার আওতায় ছিল এটি। ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির জন্য যে পরিমাণ বিস্ফোরক প্রয়োজন, তা এখানে সবার অজান্তে জমা রাখা প্রায় অসম্ভব।

পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের মতামতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে:

. বেজমেন্টে গাড়ি পার্কিং থাকলে বাতাসের ভেন্টিলেশন থাকত। কোনো গ্যাস জমা হতো না। বিস্ফোরণও হয়তো হতো না।

. সাততলা ভবনের বেজমেন্টসহ তিনটি ফ্লোরে বাণিজ্যিক কারণে আসা লোকজন, বাসাবাড়ির লোকজনের পয়োবর্জ্য যেখানে জমা হয়, দীর্ঘ সময় সেই জায়গা পরিষ্কার না করায় সেখানেও বায়োগ্যাসের জন্ম হতে পারে, যা বিভিন্ন কারণে বিস্ফোরিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতির সৃষ্টি করে।

. একসময় এই বেজমেন্টের রান্নাঘরে বাণিজ্যিক বড় লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হতো, যা পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু বাড়ির অন্যান্য তলার আবাসিক লাইন এখনো চলমান। ফলে এই লাইন সম্পূর্ণ বন্ধ না হয়ে সেখান দিয়েও তিতাস গ্যাস লিক হতে পারে। কোনোভাবে জমা গ্যাসে স্পার্কের মাধ্যমে বিস্ফোরণ হতে পারে।

. ভবনমালিকদের তথ্যমতে, মূল ক্ষতিগ্রস্ত ভবন এবং তার উত্তর পাশে ব্র্যাক ব্যাংকের ভবনের মাঝখানে সরু একটি গলি আছে। এ গলিতে পয়োবর্জ্য পদার্থের সেপটিক ট্যাংক, এসির আউটার ইত্যাদি অবস্থিত। বিস্ফোরণে সেপটিক ট্যাংকের পাশের দেয়ালগুলো সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পয়োবর্জ্য পদার্থের বায়োগ্যাসের বিস্ফোরণে এমনটি হতে পারে।

. এই ভবনটির আন্ডারগ্রাউন্ড বা বেজমেন্টে বড় একটি স্যানিটারি দোকান, নিচতলায় পাঁচটি দোকান এবং কাপড়ের দুটি দোকান ছিল, যেগুলোর জন্য অনেক কাচ এবং ইন্টেরিয়রের কাজ করা হয় এবং শক্তিশালী এসি ব্যবহার করা হয়। এসিগুলোকে সময়ে সময়ে সার্ভিসিং না করালে বা ত্রুটিপূর্ণ থাকলে, তা থেকেও বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে, যেটা দু–তিন বছর আগে গুলশানে আরব আমিরাতের ভিসা সেন্টারে ঘটেছিল।

. ভবনটি কোনো পরিত্যক্ত পাবলিক স্পেস/ভবন নয়। ব্যক্তিমালিকানাধীন। বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা সার্বক্ষণিক নজরদারি ও সিসি ক্যামেরার আওতায় ছিল এটি। ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির জন্য যে পরিমাণ বিস্ফোরক প্রয়োজন, তা এখানে সবার অজান্তে জমা রাখা প্রায় অসম্ভব।

. বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ঢাকা মহানগরীর সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল আলাদাভাবে তদন্ত করছে। বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা একটা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে প্রতিবেদন দেবে, তাতেই প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তবে এখন পর্যন্ত বিস্ফোরক বা অন্তর্ঘাতের কোনো আলামত সেখানে পাওয়া যায়নি।

. ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সিসি ক্যামেরা ছিল। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে। ভবনের মালিক, দোকানের মালিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে বিস্ফোরণের কারণ জানা চেষ্টা অব্যাহত আছে।