মেট্রোরেলের ভাড়া: কার লাভ, কার ক্ষতি
ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলে ভ্রমণে সরকার নির্ধারিত ভাড়া নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। নির্ধারিত এই ভাড়া কারও জন্য বেশি, কারও জন্য সাশ্রয়ী হবে।
অবশ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, আধুনিক এই গণপরিবহনব্যবস্থা চালু করতে সরকার বিপুল বিনিয়োগ করেছে। মেট্রোরেলের পরিচালনা ব্যয়ও বেশি। তাই ভাড়া বেশি হয়নি। বরং ভবিষ্যতে ভাড়া আরও বাড়িয়ে এই বাহনকে লাভজনক একটা গণপরিবহনব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলার চিন্তা আছে। মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। রাষ্ট্রায়ত্ত এই কোম্পানির নিজের আয়ে চলার কথা।
ঢাকার মেট্রোরেলে ভ্রমণে সর্বনিম্ন যাত্রীভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ টাকা। আর উত্তরা থেকে মতিঝিল স্টেশন পর্যন্ত ভ্রমণের জন্য খরচ হবে ১০০ টাকা। কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ টাকা।
গতকাল মঙ্গলবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এসব তথ্য জানান। সড়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মেট্রোরেলের ভাড়াসংক্রান্ত সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপন জারি করে ভাড়ার হারের বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে।
রাজধানী ঢাকার জন্য মেট্রোরেল প্রথম। পুরোপুরি বিদ্যুতে চলবে এই ট্রেন। স্টেশন ও ট্রেনের ভেতর পুরোটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) হবে। এতে থাকছে স্থায়ী-অস্থায়ী কার্ডভিত্তিক আধুনিক টিকিট কাটার ব্যবস্থা।
ঢাকার মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণের তথ্য প্রকাশের পর কয়েকটি বিষয় সামনে এসেছে। এগুলো হলো—এই বাহনে কারা যাতায়াত করবেন, তাঁদের সামর্থ্য কতটুকু, বিদ্যমান ব্যবস্থার তুলনায় এই ভাড়া যাত্রীদের জন্য বেশি হয়ে গেল কি না। পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মেট্রোরেলে যাত্রীভাড়া কত, সেই তুলনাও সামনে আসছে।
কার লাভ, কার ক্ষতি
বর্তমানে ঢাকার গণপরিবহনের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে বাস, মিনিবাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা।
২০১৬ সালে ঢাকার জন্য করা সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজধানীর মানুষ দিনে যত যাতায়াত করে (ট্রিপ) তার ৭২ শতাংশই করে বাস-মিনিবাসে। এই যাত্রীদের ৪০ শতাংশই কম দূরত্বের পথে যাতায়াত করে।
সমীক্ষাটিতে বলা হয়, মাসিক ১০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয়ের ঢাকাবাসী সবচেয়ে বেশি চলাচল করে বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশায়।
এই সমীক্ষা থেকে ধারণা করা যায়, ঢাকায় এখন যাঁরা বাস বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা ব্যবহার করেন, তাঁরাই হবেন মেট্রোরেলের যাত্রী।
সরকার মেট্রোরেলে সর্বনিম্ন যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে, সেই ২০ টাকা দিয়ে সর্বোচ্চ দুই স্টেশন পর্যন্ত যাতায়াত করা যাবে। এক স্টেশন পর নেমে গেলেও যাত্রীকে ২০ টাকা ভাড়া দিতে হবে।
অথচ, বর্তমানে ঢাকার বাস-মিনিবাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ৮ থেকে ১০ টাকা। যাঁরা এখন সর্বনিম্ন এই ভাড়া দিয়ে ২ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে নেমে যান, তাঁদের জন্য মেট্রোরেলের ভাড়া কিছুটা বেশিই মনে হবে। কারণ, মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোর বেশির ভাগই এক-দেড় কিলোমিটারের মধ্যে। কেউ এক স্টেশন থেকে উঠে পরের স্টেশনে নেমে গেলে তাঁকে তুলনামূলক বাড়তি টাকা গুনতে হবে।
আবার যাঁরা রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা রাইড শেয়ারিংয়ে চলেন, তাঁদের জন্য মেট্রোরেলের ভাড়া সাশ্রয়ী হবে। কারণ, ঢাকায় এখন সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকার কমে কোনো ভাড়া নেই। তা ছাড়া যাত্রীর ইচ্ছামতো গন্তব্যে অটোরিকশাচালক যেতে রাজি হন না।
অন্যদিকে, ঢাকায় রিকশার ভাড়া এখন কমপক্ষে ২০ টাকা। রিকশার যাত্রীদের অনেকে মেট্রোরেলের যাত্রী হতে পারেন। মেট্রোরেলে এসি থাকায় তাঁদের জন্য যাতায়াত আরামদায়ক হবে।
বর্তমানে রাজধানীতে বড় বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ৪৫ পয়সা। মিনিবাসের ভাড়া ২ টাকা ৪০ পয়সা। সর্বনিম্ন ভাড়া বড় বাসে ১০ টাকা, মিনিবাসে ৮ টাকা।
উত্তরার আজমপুর থেকে মহাখালী, ফার্মগেট, শাহবাগ হয়ে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত সড়কপথের দূরত্ব ১৯ দশমিক ৮ কিলোমিটার। সরকারি হিসাবে, এই পথে বড় বাসে ভাড়া আসে সাড়ে ৪৮ টাকা। অবশ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা এর চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করে থাকেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের ভাড়া সরকার ঠিক করে দেয় না। এই পথে কিছু এসি বাসে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিলের দূরত্ব ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার। এই পথে ভাড়া দিতে হবে ১০০ টাকা। ফলে এই পথে মেট্রোরেলে এসি বাসের সমান, ক্ষেত্রবিশেষে কম ভাড়া পড়ছে।
তা ছাড়া ঢাকায় যেখানে-সেখানে বাসে যাত্রী ওঠা-নামা করা হয়। ঠেলতে হয় দীর্ঘ যানজট। অনেক ক্ষেত্রে পরিবহন শ্রমিকদের আচরণ থাকে রূঢ়।
অন্যদিকে, মেট্রোরেল নির্দিষ্ট স্টেশনে থামবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্টেশনে যাত্রী ওঠা-নামা করবে। মেট্রোরেলে যানজটের ঝক্কি নেই। মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাতায়াতে ৩৫ মিনিট সময় লাগবে বলে প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে। স্টেশনগুলোও থাকবে ঝকঝকে।
ভারতে ভাড়া কত
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন শহরে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার মেট্রোরেল লাইন আছে। সেখানকার মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৬০ রুপি পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হয়।
দেশটির রাজধানী নয়াদিল্লিতে মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ রুপি। সর্বোচ্চ ভাড়া ৬০ রুপি।
কলকাতায় মেট্রোরেলে সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ রুপি, সর্বোচ্চ ২৫ রুপি।
ভারতে মেট্রোরেল ব্যবস্থা অনেক বিস্তৃত। ফলে যাত্রীরা মেট্রোরেলে একাধিক পথে বহু গন্তব্যে যাতায়াত করতে পারেন। ঢাকায় শুধু একটা পথেই মেট্রোরেল চালু হচ্ছে।
কী বিবেচনায় ভাড়া নির্ধারণ
জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, পরিচালন ব্যয়, সুযোগ-সুবিধা ও আরামদায়ক বিবেচনা করলে ঢাকার মেট্রোরেলের নির্ধারিত ভাড়া কমই বলা যায়।
এম এ এন সিদ্দিক বলেন, ‘আশপাশের দেশের মেট্রোরেলের ভাড়া বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের আয়ের দিকটিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, ঢাকার যাত্রীরা মেট্রোরেল ভ্রমণ সাদরে গ্রহণ করবেন।’
যাত্রী কী বলছেন
রাজধানীর গাবতলী এলাকায় অবস্থিত একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন এনামুল হক। তিনি প্রতিদিন মিরপুর পল্লবী থেকে কখনো বাসে, কখনো সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা উবারে যাতায়াত করেন। এই গন্তব্যে বাসে তাঁর খরচ হয় ৫০ টাকার মতো। সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা উবারে উঠলে লাগে ২০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। তিনি চাইলে পল্লবী থেকে মিরপুর-১০ পর্যন্ত মেট্রোরেলে ৩০ টাকায় যেতে পারবেন। সেখানে নামার পর মূল গন্তব্যে যেতে তাঁকে বাস বা অন্য যানে ওঠার ঝক্কি পোহাতে হবে।
এনামুল প্রথম আলোকে বলেন, এখন উত্তরা ও মিরপুর থেকে আগারগাঁও হয়ে যেসব যাত্রী চলাচল করে, তাঁদের জন্য মেট্রোরেল সাশ্রয়ী-আরামদায়ক বাহন হবে। প্রস্তাবিত ছয়টি মেট্রোরেলের সবগুলো লাইন ঢাকায় চালু হলে পুরো নগরের মানুষ সুবিধা পাবে। তখন ভাড়া নিয়ে খুব একটা সমস্যা হবে না।
টিকিটব্যবস্থা যেমন হবে
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে, মেট্রোরেলে দুই ধরনের টিকিটের ব্যবস্থা থাকবে। একটা হলো স্থায়ী কার্ড। এই কার্ড রিচার্জ করে পুরো বছর বা মাসে যাতায়াত করা যাবে। এই কার্ড কিনতে ২০০ টাকা দিতে হবে। এরপর ২০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত রিচার্জ করা যাবে। অনলাইন লেনদেনের মাধ্যমে কার্ড রিচার্জ করা যাবে।
মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশনে থাকা মেশিনেও কার্ড রিচার্জ করা যাবে। প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের সময় যাত্রীদের কার্ড পাঞ্চ করতে হবে। নতুবা দরজা খুলবে না। নেমে যাওয়ার সময় আবার কার্ড পাঞ্চ করতে হবে। নতুবা যাত্রী বের হতে পারবেন না।
আরেকটি কার্ড সাময়িক, যা প্রতি যাত্রায় দেওয়া হবে। স্টেশন থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যের ভাড়া দিয়ে এই কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। এটিও স্মার্টকার্ডের মতো। ভাড়ার অতিরিক্ত যাতায়াত করলে এই কার্ড দিয়ে যাত্রী দরজা খুলতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কাছে বাড়তি ভাড়া পরিশোধ করে যাত্রীকে বের হতে হবে।
মেট্রোরেলের স্টেশনে লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যাবে। তিনতলা স্টেশন ভবনের দ্বিতীয় তলায় কনকোর্স হল থাকবে। সেখানে টিকিট কাটার ব্যবস্থা, অফিস ও নানা যন্ত্রপাতি থাকবে। তিনতলায় রেললাইন ও প্ল্যাটফর্ম। একমাত্র টিকিটধারী যাত্রীই তিনতলায় যেতে পারবেন। দুর্ঘটনা এড়াতে রেললাইনের পাশে বেড়া থাকবে। স্টেশনে ট্রেন থামার পর বেড়া ও ট্রেনের দরজা একসঙ্গে খুলে যাবে। আবার নির্দিষ্ট সময় পর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হবে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যাত্রী নিয়ে চলাচল শুরু হলে মেট্রোরেল ভোর থেকে দুই দিক থেকে যাত্রা করবে। প্রাথমিকভাবে রাত সাড়ে ১১টায় সবশেষ ট্রেন ছাড়বে।