ক্রেতা–বিক্রেতা উভয়ই খুশি ঢাকার যে মার্কেটে

পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে জমজমাট হয়ে উঠেছে হোপ মার্কেট। আজ বৃহস্পতিবার মিরপুর ১০ নম্বরেছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে মিরপুর ১০ নম্বর, মেট্রোরেলে নিমেষেই চলে গেলাম। মেট্রো থেকে নামার পর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালকের কাছে হোপ মার্কেট চেনেন কি না, জানতে চাইলে একটু বিরক্তই হলেন। বললেন, ‘এই এলাকায় থাকি, আর হোপ মার্কেট চিনব না?’

মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ৩০ বছর বয়সী অটোচালক মো. সুজন জানালেন, তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে ছোট ছেলে রিফাত ঈদের কেনাকাটার জন্য কান্নাকাটি শুরু করেছে। কেনাকাটা কোথা থেকে করবেন—জানতে চাইলে সুজন বললেন, ‘কই আর যামু? হোপ মার্কেট থেইক্যাই কিনাকাটা করমু। ছেলেদের জন্য পায়জামা, পাঞ্জাবি আর মেয়ের জন্য থ্রি–পিস কিনমু।’

হোপ মার্কেট থেকেই কেন কেনাকাটা করতে চাচ্ছেন, এ প্রশ্নে ময়মনসিংহের শেরপুর থেকে আসা অটোচালক সুজন বললেন, ‘ফুটপাতের হোপ মার্কেট হইল গরিবের মার্কেট। সস্তায় এইখান থেকে জিনিস কিনোন যায়। শোরুমে তো ঢুকনই যায় না।’

অটোচালক সুজন হোপ মার্কেটে নামিয়ে দিলেন। মিরপুর ১০ নম্বরের ব্লক বি–তে হোপ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। হোপ মার্কেটের ক্রেতা-বিক্রেতাদের মুখে মুখে যে গল্পটা প্রচলিত আছে তা হলো, স্কুলটিকে কেন্দ্র করে আশপাশের ফুটপাতে প্রায় ১৫ বছর আগে কয়েকটি দোকান ছিল। ক্রেতা ছিলেন মূলত স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা। স্কুলসহ এ এলাকার আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও কেনাকাটা করতেন। কম দামে ভালো পণ্য পাওয়া যায় বলে আস্তে আস্তে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। মার্কেটের বিস্তৃতিও বাড়তে থাকে।

এখন ১০ নম্বর গোলচত্বর পার হলেই (মিরপুর ১৪ নম্বরের দিকে যেতে) অসংখ্য দোকান। কেউ ভ্যানে জিনিস নিয়ে বসেছেন। কেউ দোকান বানিয়ে বসেছেন। আর অনেকে সড়কে মোটা পলিথিন বিছিয়ে সেখানেই পণ্য সাজিয়ে বসেছেন। আবার কেউ নিজের শরীরকেই হ্যাঙ্গার বানিয়ে গামছা, বালিশের কভারসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছেন।

একটু পরপর ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ‘আড়াই শর গেঞ্জি লন দেড় শ টাকায়’; ‘ওই কী রে, ওই কী রে’; ‘চলছে বিশাল ডিসকাউন্ট’; ‘দামাদামি করতে চাইলে ফার্মগেট চইলা যান’—এমন হাঁকডাক দিচ্ছিলেন বিক্রেতারা।

সময় গড়াতে থাকে, আর হোপ মার্কেটে ক্রেতাদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে সেখানে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। বিক্রেতারা জানালেন, মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর এ মার্কেটে ক্রেতার সংখ্যা বেড়েছে। অ্যাপ্রন পরা চিকিৎসক, গলায় আইডি কার্ড ঝোলানো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অফিসফেরত নারী-পুরুষ—এমনকি কেউ কেউ কয়েক মাস বয়সী সন্তানকে পাতলা তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে মার্কেটে এসেছেন। ক্রেতাদের মধ্যে নিম্নবিত্তদের পাশাপাশি মধ্যবিত্তদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। বিক্রেতাদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যা বেশি। নারী ও শিশু বিক্রেতাও আছে।

বিকেল হলে হোপ মার্কেটে বেড়ে যায় ক্রেতাদের ভিড়। আজ বৃহস্পতিবার মিরপুর ১০ নম্বরে
ছবি: প্রথম আলো

ঈদের বাজারে বড় বড় বিপণিবিতানে বিক্রেতারা যেমন গলা শুকিয়ে বলেন, ‘বেচাকেনা নাই’, এখানের চিত্রটা উল্টো। ক্রেতারা কিছু না কিছু কিনছেন। যে বিক্রেতাদের কিছুটা কম বিক্রি হচ্ছে তাঁরাও শুকরিয়া আদায় করে বলছেন, ফুটপাতের মার্কেট, সেই তুলনায় এখানে বিক্রি ভালোই বলতে হবে। ক্রেতাদের মুখেও সন্তুষ্টি। দরদাম করে, দেখেশুনে, তুলনামূলক কম দাম দিয়ে ভালো পণ্যটাই কিনতে পারছেন তাঁরা।

বিল্লাল মিয়ার অফিস মতিঝিলে, বাসা মিরপুরের কাজীপাড়ায়। মঙ্গলবার অফিস থেকে ফেরার পথে এসেছিলেন হোপ মার্কেটে। সমস্যা হলো ভাতিজির বয়স মাত্র দেড় বছর। কোনোভাবেই বিক্রেতাকে শিশুটির জন্য জামার সাইজ বোঝাতে পারছিলেন না। তারপর বাসায় মুঠোফোনে ভিডিও কল দিলেন। সমস্যার সমাধান হলো। বিল্লাল মিয়া জানালেন, এর আগে তিনি ছেলের জন্য এখান থেকেই কেনাকাটা করেছেন। ভাতিজির জামা কেনার পর অন্য আরেক ভাগনির জন্যও ঈদের জামা কিনে হাসিমুখে বাড়ির পথ ধরলেন তিনি।

ঈদের সময় অন্য বিপণিবিতানে বিক্রেতারা আকাশছোঁয়া দাম চাইলেও হোপ মার্কেটে তেমনটি দেখা গেল না। চার বছর ধরে এ মার্কেটে কেনাকাটা করেন লিলিকা চাকমা। বললেন, ‘ঈদের সময় বলে এখানে বিক্রেতারা দাম তেমন বাড়াননি। দামাদামি করা যায়। আর এই মার্কেট হলো গরিবের আরামের মার্কেট। শোরুমে তো আমাদের সবার যাওয়ার সামর্থ্য নেই।’

জামাকাপড় থেকে জুতা, ঘর সাজানোর জিনিস—কী পাওয়া যায় না হোপ মার্কেটে। আজ বৃহস্পতিবার মিরপুর ১০ নম্বরে
ছবি: প্রথম আলো

ফুটপাতের এ মার্কেটে একটু পরপর ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ‘আড়াই শর গেঞ্জি লন দেড় শ টাকায়’; ‘ওই কী রে, ওই কী রে’; ‘চলছে বিশাল ডিসকাউন্ট’; ‘দামাদামি করতে চাইলে ফার্মগেট চইলা যান’—এমন হাঁকডাক দিচ্ছিলেন বিক্রেতারা। দেখা মিলল নারী বিক্রেতাদেরও। ফারজানা বেগম সড়কে পলিথিন বিছিয়ে তিন বছর ধরে জামাকাপড় বিক্রি করেন। গাউছিয়া থেকে পণ্য নিয়ে আসেন। বললেন, ‘ফুটপাতে ব্যবসা করি, এ নিয়া লজ্জার কিছু নাই।’

অন্য জায়গার তুলনায় এখানে পণ্যের দাম আসলেই কম, তা ক্রেতারাই স্বীকার করছেন। বাটিকের থ্রি-পিস ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।

স্থায়ী-অস্থায়ী দোকান, ফুটপাত, হকার ও হোপ প্লাজা মিলিয়ে মার্কেটের পণ্যগুলো দেখে যা মনে হলো, একটু খুঁজলে এখানে পাওয়া যাবে না, এমন কোনো জিনিস নেই। থ্রি-পিস, কুর্তা, কাফতান, টপ ও লং শার্ট, পাঞ্জাবি, গ্যাবার্ডিন ও জিনসের প্যান্ট, বাহারি জুতা, ব্যাগ, থালাবাসন, ঘর সাজানোর জিনিস, প্লাস্টিকের ফুল, পাপোশ, আতর, মেহেদি, কাজল, টিপ, লিপস্টিক, বোরকা, হিজাব, গজ কাপড়, ওড়না, চুড়ি, মালা, বাচ্চাদের কাপড়, খেলনা—সবই মিলছে। নারী ও শিক্ষার্থীদের অনেকে বাসায় বানানো বিভিন্ন খাবার এনেও বিক্রি করছেন। কাঁচা আমের ভর্তা, জুস, কুলফি, আচারসহ নানান মুখরোচক খাবারের সমারোহ তো আছেই।

ফুটপাতে পাঞ্জাবি সাজিয়ে বসেছেন একজন বিক্রেতা। গত মঙ্গলবার মিরপুর ১০ নম্বরে
ছবি: মানসুরা হোসাইন

অন্য জায়গার তুলনায় এখানে পণ্যের দাম আসলেই কম, তা ক্রেতারাই স্বীকার করছেন। বাটিকের থ্রি–পিস ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। বিক্রেতা রাজিয়া জানালেন, বড় সুতি ওড়নার দাম ১২০ টাকা। ভ্যানে বিক্রি করা বাহারি ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। ঈদের পাঞ্জাবিও ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। কম দামে কীভাবে পণ্য বিক্রি করতে পারছেন, এ প্রশ্নের উত্তরে বিক্রেতারা জানালেন, এখানে দোকান ভাড়া দিতে হয় না।

পুলিশকে টাকাপয়সা দিতে হয় কি না, জানতে চাইলে সরাসরি উত্তর পাওয়া গেল না। তবে কয়েকজন বিক্রেতা বললেন, ‘লাইনে’ টাকা দিতে হয়। একটু পরেই চোখে পড়ল পুলিশের উপস্থিতি। ঈদের আগে বলে হয়তো পুলিশকেও তেমন কিছু বলতে দেখা গেল না। তবে বিরতি নেই ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের। যানজট নিয়ন্ত্রণে আপ্রাণ চেষ্টা করেই যাচ্ছিলেন তাঁরা।

বিক্রি হচ্ছে শিশুদের পুতুল। গত মঙ্গলবার মিরপুর ১০ নম্বরে
ছবি: মানসুরা হোসাইন