জনগণ তাদের চাওয়া–পাওয়া সরকারের কাছে তুলে ধরার উপযুক্ত মাধ্যম খুঁজে পাচ্ছে না। নির্বাচনের আগে জনপ্রতিনিধিদের কাছে জনগণ তাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরতে পারলেও নির্বাচনের পর সে সুযোগ কমে গেছে। আজ শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত নাগরিক সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
সম্মেলনে আরও বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির প্রক্রিয়ায়ও জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না।
অনুষ্ঠানে সিপিডি পরিচালিত ‘জাতীয় উন্নয়নে অঙ্গীকার: শিক্ষা, শোভন কর্মসংস্থান, জেন্ডার সমতা’ শীর্ষক প্রকল্পের ফলাফল তুলে ধরা হয়। এই প্রকল্পে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালে করা নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষা, শোভন কর্মসংস্থান ও লিঙ্গসমতাসংক্রান্ত প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। ওই ইশতেহার নিয়ে জনগণের মনোভাব জানতে ১৫টি জেলায় ৯০টি উঠান বৈঠকের আয়োজন করেছিল সিপিডি। এসব বৈঠকে ৯১৮ জন অংশ নেন। এ ছাড়া রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামে আঞ্চলিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ওই সব সম্মেলনে মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
মুক্ত আলোচনায় উঠে আসা মানুষের মতামত তুলে ধরে আজ অনুষ্ঠানে সিপিডি জানায়, বেশির ভাগ মানুষ বলেছেন, তাঁরা নিজেদের চাহিদা বা দাবি সরাসরি বা লিখিত আকারে প্রার্থীদের জানাতে পারেননি। তবে কেউ কেউ সরাসরি সংসদ সদস্যদের কাছে স্থানীয় সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পেরেছেন। পাশাপাশি মানুষ শিক্ষা খাতকে দুর্নীতি ও রাজনীতিমুক্ত, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও জনগণকে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করতে ঋণসংক্রান্ত জটিলতা দূরীকরণ, নারী-পুরুষের মজুরিবৈষম্য দূর করে নারীদের কাজের সুযোগ বাড়াতে শহর ও গ্রামে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনসহ বিভিন্ন বিষয়ে মতামত জানিয়েছেন।
দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান তাঁর এলাকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, তৃণমূলের মানুষের চাহিদার সঙ্গে সংলাপে উঠে আসা মতামতের মিল খুঁজে পাননি তিনি। জনপ্রতিনিধিরা দলের নির্বাচনী ইশতেহারের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের সঙ্গে একধরনের মৌখিক অঙ্গীকার করেন। জনগণ সবচেয়ে বেশি চান সামাজিক ভাতা কার্ড, খাবার পানির ব্যবস্থা, স্যানিটেশন, এলাকায় রাস্তা, কালভার্ট ও একটি ভালো কাজ পাওয়ার সুযোগ। আগে বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও এখন সেটি নেই।
এখন নির্বাচনের আগেও যোগাযোগ হয় না, পরেও হয় না। এখন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জনসংযোগের প্রয়োজন হয় না। নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে, সংসদ সদস্যরা মুখের চেয়ে হাত-পা বেশি চালান
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘ব্যয় সংকোচনের কথা বলা হচ্ছে না। যথাযথ ব্যয় করতে বলা হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে যে ঢেউ উঠেছে, তাতে আমাদের তরিও কাঁপছে। এতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।’
আলোচক হিসেবে অনুষ্ঠানে অংশ নেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ, বেসরকারি সংস্থা ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশী কবির।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার যদি কথার কথা হয়, তাহলে সেটি করা না–করা একই। দেখা গেছে নির্বাচনের তিন দিন আগেও ইশতেহার করা হচ্ছে। অথচ ইশতেহার নির্বাচনের আগে আলোচনার মাধ্যমে এক বছর ধরে তৈরি হওয়া উচিত। ওই সব প্রক্রিয়া এ দেশে নেই। কারণ, এখানে নির্বাচনী ইশতেহার কথার কথা। সত্যিকারের নির্বাচন হলে ইশতেহারের গুরুত্ব থাকত। দলের গঠনতন্ত্রও কথার কথা। অথচ দলই দেশ চালাচ্ছে।
জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ বলেন, এখন নির্বাচনের আগেও যোগাযোগ হয় না, পরেও হয় না। এখন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জনসংযোগের প্রয়োজন হয় না। নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে, সংসদ সদস্যরা মুখের চেয়ে হাত-পা বেশি চালান। বিশেষ করে শিক্ষকদের ওপর।
খুশী কবির বলেন, সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে, জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। সবকিছু সহ্য করার মানসিকতায় পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল—২০২১ সালের আগে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, ২০২০ সালের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)’ অর্জন, ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশের মর্যাদা লাভ, ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা’ বা ডেলটা প্ল্যান ২১০০ বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হওয়া। এ ছাড়া ইশতেহারে ৩৩টি খাতে জোর দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানের সভাপতি সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ইশতেহারের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রতি তাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের একটি ধারণা দেয়। ইশতেহার আইনগত দলিল না হলেও এর গুরুত্ব রয়েছে। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সিপিডির এ তথ্যগুলো নির্দেশনামূলক হতে পারে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ইশতেহার বাস্তবায়নে জনপ্রতিনিধিদের হয়তো সদিচ্ছা আছে। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতা বা দুর্বলতায় জনগণ সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
লিঙ্গসমতাবিষয়ক অধিবেশনে
লিঙ্গসমতাবিষয়ক প্রথম অধিবেশনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. আবদুল আজিজ বলেন, কাজের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করলে নারীরা সমানভাবে অংশ নিতে পারে। অনেক মা–বাবার অসচেতনতায় মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হয় এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়ে।
আরেক সংসদ সদস্য আরমা দত্ত বলেন, লিঙ্গসমতা অর্জনের ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা একটি বড় বাধা।
এই অধিবেশনে অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর, রংপুর থেকে আসা নারীনেত্রী মোশফেকা রাজ্জাক।
অধিবেশনে লিঙ্গসমতা বিষয়ে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা ফেলো সৈয়দ ইউসুফ সাদাত। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন খুশী কবির।