রাজধানীর বাজারে ‘ককশিটের ইলিশ’ বেশি, দামও কমেছে
সব বাজারেরই কিছু ‘নিজস্ব শব্দ’ থাকে। তা সবজির বা মাছের, যে বাজারই হোক। এসব শব্দ বা শব্দগুচ্ছ সাধারণত ব্যবসায়ীদের মধ্যেই ব্যবহৃত হয়। যেমন ইলিশের বাজারে আছে ‘ককশিটের ইলিশ’ ও ‘লাইনের ইলিশ’। কারওয়ান বাজারের পাইকারি ও খুচরা—দুই বাজারেই এ শব্দ শোনা যায়। ককশিটের ইলিশ হচ্ছে সাগর থেকে ধরা কক্সবাজার বা চট্টগ্রামের ইলিশ। আর লাইনের ইলিশ হলো বরিশাল, ভোলা বা চাঁদপুরের নদী থেকে আসা ইলিশ।
সাগরে মাছ ধরার ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা গত শনিবার মধ্যরাতে উঠে গেছে। ওই দিনই সাগরে ছুটে গেছেন হাজার হাজার জেলে। সাগরে, বিশেষ করে কক্সবাজার এলাকায় মাছও মিলছে ভালো। রাজধানীর বাজারে আজ মঙ্গলবার ঘুরে এর প্রভাব দেখা গেল।
মাছের সরবরাহ ভালো, দামও আগের দুই দিনের চেয়ে খানিকটা কম। সাগরে বেশি ইলিশ ধরা পড়ায় সরবরাহ বেড়েছে বলে মনে করছেন সব বিক্রেতা। তবে তাঁদের ইলিশ সাগরের কি না, এমন প্রশ্ন তুললে বেমালুম অস্বীকার করছেন ব্যবসায়ীরা। কোন নদীর, কোন এলাকা থেকে কখন এসব মাছ এসেছে, তার ফিরিস্তি তুলে ধরছেন।
নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর জেলেদের কেউ গেছেন গভীর সমুদ্রে, কেউ ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার এলাকায়। কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলছিলেন, যাঁরা কাছাকাছি গিয়েছিলেন, তাঁরা ফিরে আসছেন। তাঁদের কাছে ভালোই ইলিশ এসেছে।
কক্সবাজার ফিশারিঘাটে পাইকারি ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের ১০০ ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৫ হাজার টাকায়, ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ১০০ ইলিশ ৩৫ হাজার টাকায়, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ১০০ ইলিশ ৪২ হাজার টাকায়, ৯০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ১০০ ইলিশ ৭০ হাজার টাকায় এবং এক থেকে দুই কেজি ওজনের ১০০ ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায়।
দেলোয়ার বলেন, যাঁরা গভীর সমুদ্রে গেছেন, তাঁদের আসতে আরও দুদিন লাগবে।
বাজারে বেশি ইলিশ আসার খবর পৌঁছে গেছে নগরবাসীর কাছে। আজ কর্মদিবস হলেও রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ক্রেতাদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। পাইকারি বাজারের কাছে কয়েকজন মাছ ব্যবসায়ী খুচরায় মাছ বিক্রি করেন। রাস্তার পাশ ঘেঁষে বসেছিলেন মো. বশির। তাঁর কাছে আছে তিন মাপের ইলিশ। ৫৫০ থেকে ৬৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭০০ টাকায়, ৭৫০ থেকে ৮০০ গ্রামের ইলিশ ৮৫০ টাকায় আর প্রায় ২ কেজির ইলিশ ১ হাজার ৯৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। এসব মাছ ভোলা থেকে এসেছে দাবি করে বশির বললেন, ‘দুই দিন আগের চাইতে সব আকারে দেড় থাইক্যা দুই শ টাকা কমছে। আরও কমব।’
এ ব্যবসায়ী বললেন, মাছ বেশি আসছে মূলত চট্টগ্রাম থেকে, যাকে বলা হয় ককশিটের ইলিশ। তবে তাঁর কাছে কোনো ককশিটের ইলিশ নেই। সবই লাইনের জিনিস।
বাজারে সব বিক্রেতাই তাঁদের ইলিশ ককশিটের নয় বলে দাবি করছেন। তাহলে সাগরের নতুন ইলিশ কে বিক্রি করছেন, এমন প্রশ্নে বশির বললেন, ‘অন্য কারও কাছে থাকবার পারে, আমার কাছে নাই।’
ককশিটের ইলিশ আছে, এমন কাউকে অবশ্য বাজারে খুঁজে পাওয়া গেল না।
পাইকারি বাজার ছেড়ে কিচেন মার্কেটে এসে দেখা যায়, বাজার সরগরম। মাছের ১৮ থেকে ২০ দোকানির মধ্যে ছয়জনের কাছে ইলিশ আছে। তাঁদের কাছে বেশ ভিড়। পাইকারির চেয়ে এখানে দাম একটু বেশি, যদিও তা আগের তুলনায় খানিকটা কম। বিক্রেতা মারুফ ৯০০ গ্রামের ইলিশ ১ হাজার ২০০ টাকা, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রামের ১ হাজার টাকা এবং ১ হাজার ২০০ গ্রামের ইলিশ দেড় হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন। তাঁর কাছেও ককশিটের ইলিশ নেই বলে দাবি করেন। মাছগুলো তুলে ধরে মারুফ বললেন, ‘এমন চকচইক্যা ইলিশ সাগরের অয়? ইলিশ যে চেনে, হেই জানে এগুলা কোনহানের।’
বিক্রেতা সুমনের দোকানে দরদাম করছিলেন মো. তোয়াব হোসেন। মগবাজারের বাসিন্দা এই সাবেক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বলছিলেন, ইলিশের দাম খানিকটা কমেছে। সাগরে বেশি ইলিশ ধরা পড়ায় হয়তো এমনটা হয়েছে।
খুচরা বাজারের সব ব্যবসায়ীরও দাবি, তাঁদের মাছ নদীর বা লাইনের। একজনকে পাওয়া গেলে ব্যতিক্রম। তিনি রায়হান মিয়া। বাজারের এক কোণে এক ঝাঁকিতে ইলিশ বিক্রি করছিলেন। ককশিট বনাম লাইনের ইলিশের বিতর্কে তাঁর কথা, ‘আগের চাইতে বেশি ইলিশ পাওয়া যাইত্যাছে। এগুলান আসতেছে কোথাইক্যা। কেউরে না কেউরে তো এগুলা বিক্রি করতে অইব।’
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীদের ভাষায় যা ককশিট, মোহাম্মদপুরের কাটাসুর কাঁচাবাজারে তা প্লাস্টিক। বাজারের ছয়টি দোকানে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতারা বলছেন, আকারভেদে আগের তুলনায় কেজিতে ইলিশের দাম ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। বেচাকেনাও বেড়েছে।
এই বাজারের বিক্রেতা আবদুল সালাম ৬০০-৭০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ ৮০০ টাকা, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ১ হাজার টাকা, ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১ হাজার ২০০ টাকা করে বিক্রি করছেন। ১ কেজি বা এর চেয়ে বড় ইলিশ প্রতি কেজি ১ হাজার ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতা আবদুল সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে এক কেজি বা তার বড় ইলিশ প্রতি কেজি ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি করতাম। সেই তুলনায় কেজিতে ২০০-৩০০ টাকা কমেছে। বাজারে ইলিশ মাছের সরবরাহ ভালো।’
এই বাজার থেকে প্রায় ৮০০ গ্রাম ওজনের তিনটি ইলিশ কেনেন বেসরকারি একটি হাসপাতালের কর্মকর্তা শান্তি রঞ্জন হালদার। ওই তিনটির ওজন হয় ২ কেজি ৩০০ গ্রাম। দাম আসে ২ হাজার ২৭০ টাকা। ইলিশ যেভাবে ধরা পড়ছে, তাতে দাম আরও কম হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।