শহর পরিচ্ছন্নতায় হাত দিলেন শিক্ষার্থীরা
ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে শিক্ষার্থীরা রাজধানীর পথে নেমেছিলেন গতকাল মঙ্গলবার থেকে। আজ বুধবার তাঁরা হাত লাগিয়েছেন সড়কের আবর্জনা পরিষ্কার ও দেয়াললিখন মুছে পরিচ্ছন্ন করার কাজে।
রাজধানীর জনজীবনে ক্রমেই গতিময়তা ফিরে আসছে। পুরো স্বাভাবিক তা বলা যায় না। আগের দিনের তুলনায় আজ অনেক বেশি নগর পরিবহনের বাস আর ব্যক্তিগত গাড়ি নেমেছে সড়কে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রিকশা চলছে প্রচুর। তবে এখনো ট্রাফিক পুলিশ যানবাহন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নেয়নি।
মৎস্য ভবন, মৌচাক, মগবাজার ও মালিবাগ আবুল হোটেল এলাকাসহ বেশ কিছু স্থানে সড়কের মোড়গুলোয় আনসার সদস্যদের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে। তবে প্রায় সব এলাকাতেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীদেরই সকাল থেকে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে। গতকালের তুলনায় আরও ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণের এই দায়িত্ব পালন করছেন।
এদিকে আজ সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শত শত শিক্ষার্থীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে দেখা গেছে। তাঁরা গ্লাভস হাতে দিয়ে কোথাও সড়ক ঝাড়ু দিয়েছেন। কোথাও আবর্জনা কুড়িয়ে বস্তায় ভরেছেন। আবার শিক্ষার্থীদের অনেকে দলে দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন এলাকার দেয়াল ও সড়কদ্বীপে আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগের আন্দোলনে লেখা স্লোগান মুছে ফেলে আগের চেহারায় নিয়ে এসেছেন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী লালমাটিয়া মহিলা কলেজ, ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কসংলগ্ন এলাকা, রবীন্দ্রসরোবর উন্মুক্ত মঞ্চ ও আশপাশের এলাকা এবং ধানমন্ডির ২ ও ৩ নম্বর সড়ক ও সীমান্ত স্কয়ার এলাকায় পরিচ্ছন্নতা ও দেয়াললিখন মুছে নতুন করে রং করার কাজ শুরু করেন।
দুপুর ১২টার দিকে ধানমন্ডি ২ নম্বর সড়কে এমন একটি দলকে আশপাশের বাড়ি, অফিস ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে দেয়াললিখন পরিষ্কার করতে দেখা গেল। তাদের দলনেতা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ফাহমিদা মোমতাজ শিক্ষার্থীদের হাতে সিরিশ কাগজ, ব্রাশ ও রঙের পাত্র তুলে দিচ্ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা নিজেরা ও বিভাগীয় শিক্ষকদের দেওয়া অর্থে একটি তহবিল গঠন করেছেন। সেই অর্থেই এই পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। ধানমন্ডি ও লালমাটিয়া এলাকায় তাঁদের প্রতিটি দলে ৫০ জন করে চারটি দল কাজ করছে। তবে এই সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ, ব্র্যাক ছাড়া পরে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কয়েক দিন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কাজ না করায় সড়কগুলোয় বেশ আবর্জনা জমেছিল। সকাল থেকে প্রায় স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অর্ধশত শিক্ষার্থী পরিচ্ছন্নতার কাজে হাত লাগান। তাঁদের দলপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সাফওয়ান সিনবিদ জানান, তাঁরা উদয়ন স্কুলের সামনে, শহীদ মিনার ও টিএসসি এলাকা থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করে সেগুলো শহীদ মিলন চত্বরের পাশে স্তূপ করে আগুনে পুড়িয়ে দেন।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি দলকে বেলা দেড়টায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (সাবেক শেরাটন) মোড়ের সড়কদ্বীপে ভাস্কর মৃণাল হকের ‘রাজসিক’ নামের ভাস্কর্যটি পরিচ্ছন্ন করতে দেখা যায়। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ির এই ধাতব ভাস্কর্য ও বেদিতে আন্দোলন চলার সময়ে বিক্ষুব্ধরা সরকার পতনের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান লিখে ছিলেন। এতে ভাস্কর্যটি কদর্য হয়ে পড়েছিল।
এখানে দলপতি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী অতনু মল্লিক জানান, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২০ শিক্ষার্থী এখানে কাজ করছেন। তাঁরা চেষ্টা করছেন ভাস্কর্যটির মূল রং ঠিক রেখে পরিষ্কার করতে। এ জন্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের পরামর্শে প্রথমে এক ধরনের রাসায়নিক দ্রবণে নরম তোয়ালে ভিজিয়ে লেখাগুলো মুছে ফেলছেন। পরে সে স্থানটি পলিশ করা হচ্ছে।
মিন্টো রোডের মন্ত্রীপাড়ায় এখন খাঁ খাঁ নির্জনতা। গাছের ঝরা পাতাসহ হরেক রকমে আবর্জনা জমেছে। বেলা দুইটার দিকে ঝাড়ু দিয়ে সেসব আবর্জনা পরিষ্কার করতে দেখা গেল একদল শিক্ষার্থীকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তামিরা সুলতানা, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসসির শিক্ষার্থী রামিশা মাহজাবিন, মহসিনা শাওলিনসহ অনেকে।
এই শিক্ষার্থীদের দলনেতা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের আফরা ইবনাত জানান, ফেসবুকের একটি গ্রুপে শহর পরিচ্ছন্ন করার কাজে আহ্বান জানানো হয়েছিল। সেই সূত্রে তাঁরা সবাই সমবেত হয়ে বেলা ১১টা থেকে রমনা, অফিসার্স ক্লাব, মিন্টো রোড ও এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় ঝাড়ু দিয়ে আবর্জনা পরিষ্কার করছেন।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের একদল শিক্ষার্থী কাজ করছিল তাঁদের স্কুলের চারপাশের দেয়াল, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ ও স্কুলের দেয়াললিখন মুছে ফেলতে। তাঁদের একটি দলের সমন্বয়কারী এসএসসি পরীক্ষার্থী কারার মৌমিতা। সে জানায়, সকাল থেকে তাদের স্কুলের চার শর বেশি শিক্ষার্থী বেশ কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে তাদের স্কুলসহ বেইলি রোড ও সিদ্ধেশ্বরী এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দেয়ালে নতুন করে রং করার কাজ করছে। নিজেদের ও অভিভাবকদের টাকা দিয়ে তহবিল গঠন করে রং ও অন্যান্য সামগ্রী কিনেছে তারা।
নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে পরিচ্ছন্নতার কাজ করেছে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ, মতিঝিলের শাপলা চত্বর, শান্তিনগর ও মগবাজার এলাকায়।
নটর ডেমের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল নাহিয়ান জানায়, নটর ডেমের শিক্ষার্থীরা পরিচ্ছন্নতার কাজ ছাড়া সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির পাহারা দেওয়ার কাজ করছে। গতকাল থেকে প্রতি দলে ১৫ জন করে শিক্ষার্থীর তিনটি দল পালাক্রমে মন্দির পাহারা দিচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা আগামীকাল বৃহস্পতিবারেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পরিচ্ছন্নতার কাজে অংশ নেবেন।