সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল ৪টা—টিসিবির ট্রাকের পেছনে এই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন খণ্ডকালীন গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে সংসার চালানো ইরুন্নেসা। আশা, যদি কম দামে তেল-ডাল কেনা যায়। তবে পুরোটা সময় দাঁড়িয়ে থাকাটাই বৃথা গেছে। ইরুন্নেসার পালা আসার আগেই টিসিবির ট্রাকের পণ্য ফুরিয়ে গেছে।
শুধু ইরুন্নেসা নয়, শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে যেতে হয়েছে আরও প্রায় ২০ জনকে, যাঁরা শেষ পর্যন্ত লাইনে ছিলেন। এর বাইরে পণ্য পাওয়ার আশা না দেখে কেউ কেউ মাঝপথেই ফিরে গেছেন।
এই ঘটনা ঘটেছে গতকাল বুধবার ঢাকার মোহাম্মদপুরের টাউন হল মোড়ে। সেখানে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) একটি ট্রাক পণ্য বিক্রি করতে দাঁড়িয়ে ছিল।
পণ্য না পেয়ে ক্লান্ত ও ক্ষুব্ধ ইরুন্নেসা প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাই ব্লাড প্রেশার (উচ্চ রক্তচাপ) নিয়া দাঁড়ায়া আছি কয়েক ঘণ্টা। মানুষের বাসার কাজ বাদ দিয়া আইছি। জিনিস নাকি শেষ হইয়া গ্যাছে। এখন তো কিছু করার নাই।’ তিনি বলেন, কাজে যেতে পারেননি বলে গৃহকর্ত্রী ফোন করে রাগারাগি করেছেন। ওদিকে তিনি তেল-ডালও পাননি।
ঢাকায় টিসিবি ভর্তুকি মূল্যে সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল ও পেঁয়াজ বিক্রি করে। টিসিবির ট্রাক থেকে দুই লিটার সয়াবিন তেল কেনা যায় ২২০ টাকায়, বাজারে যা ৩৩০ টাকা। টিসিবি চিনি বিক্রি করে ৫৫ টাকা কেজিতে। বাজার থেকে চিনি কিনতে দাম পড়ে কেজিপ্রতি ৭৮ থেকে ৮০ টাকা। টিসিবি মসুর ডাল বিক্রি করে ৬৫ টাকায়, যা বাজারে ৯৫ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। বাজার থেকে যে পেঁয়াজ কিনতে ৫০ টাকা লাগে, একই পেঁয়াজ টিসিবির ট্রাক থেকে ৩০ টাকায় কেনা যায়।
দেশের বাজারে সম্প্রতি নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় টিসিবির ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ লাইন তৈরি হচ্ছে। অবশ্য সে তুলনায় পণ্য বরাদ্দ কম থাকে। দিনে একটি ট্রাকে যে পরিমাণ পণ্য দেওয়া হয় তা দিয়ে ২৫০ জন ক্রেতার চাহিদা মেটানো যায়।
মোহাম্মদপুরের টাউন হল মোড়ে টিসিবির ট্রাকের কাছে গতকাল বেলা পৌনে ১১টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, নারী ও পুরুষের আলাদা লাইনে ৩০০ জনের মতো মানুষ দাঁড়িয়ে। লাইনের পেছনে নতুন নতুন ক্রেতা যোগ দিচ্ছেন। তাতে সংখ্যা আরও বাড়ছে। আবার কেউ কেউ বেশি ভিড় দেখে চলেও যাচ্ছেন। কিন্তু অনেকেই তীব্র রোদের মধ্যে যত কষ্টই হোক, লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অনেকেই বয়স্ক। কারও কারও সঙ্গে ছিল শিশুসন্তান।
টাউন হল মোড়ে পণ্য বিক্রেতা টিসিবির পরিবেশক মিজানুল হক প্রথম আলোকে বিকেলে মুঠোফোনে বলেন, ‘পণ্য শেষ। তারপরও তাঁরা (লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তি) বলছেন, না থাকলেও দিতে হবে। বলে, “কম পড়ছে কেন?” আমার পক্ষে তো আড়াই শর বেশি মানুষকে দেওয়া সম্ভব না।’
মিজানুল আরও বলেন, ইদানীং ভিড় বেশি হচ্ছে। প্রচুর মানুষ লাইনে দাঁড়াচ্ছে।
‘এখন কম খাই’
দুপুরে ইরুন্নেসা যখন লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছেন। তিনি দুই মেয়েকে নিয়ে মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে থাকেন। ছোট মেয়ে পড়ে উচ্চমাধ্যমিকে। বড় মেয়েও তাঁর দুই কন্যাকে নিয়ে থাকেন ইরুন্নেসার সঙ্গে। বড় মেয়ে ও ইরুন্নেসা মিলে মাসে আয় করেন ১৫ হাজার টাকা। বাসাভাড়ায় চলে যায় সাড়ে ছয় হাজার টাকা। বাকিটা দিয়ে মেটাতে হয় পুরো পরিবারের খরচ।
ইরুন্নেসা বলেন, ‘আগের চেয়ে এখন কম খাই। জিনিসের দাম বাড়ছে, ইনকাম (আয়) তো বাড়ে নাই। সপ্তাহে এক দিন মাছ-মুরগি খাই। বাকি দিন নিরামিষ, ডাল, আলুভর্তা দিয়াই চলে। আগে একটু ভালোই খাইতাম। সপ্তায় ৩–৪ দিন মাছ খাইতাম।’
সাড়ে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে পণ্য পেয়ে খুশি জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বৈদ্যুতিক মিস্ত্রির কাজ করেন। নিজে থাকেন মোহাম্মদপুরের একটি মেসে। আর দুই সন্তান ও স্ত্রী থাকে ময়মনসিংহে। প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকার মতো আয় হয়। সেটা দিয়ে নিজের খরচ যেমন মেটাতে হয়, তেমনি পরিবারকে মাসে মাসে টাকা পাঠাতে হয়।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মেসে আগে খাবারের জন্য দিতে হতো আড়াই হাজার টাকা। ছয় মাস ধরে দিতে হচ্ছে তিন হাজার টাকা। আর পরিবারের মাসে লাগত পাঁচ হাজার টাকার মতো। এখন দিতে হয় সাত হাজার।
মোহাম্মদপুরের কয়েকটি জায়গায় টিসিবির পণ্য বিক্রি হয়। একেক দিন একেক জায়গায়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড ও বেড়িবাঁধের মাঝামাঝি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শ খানেক নারী-পুরুষ অপেক্ষা করছেন টিসিবির গাড়ির জন্য।
অপেক্ষারত আবদুর রহিম খান বলেন, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। সংসারে সচ্ছলতা ছিল। করোনাকালে তাঁর চাকরি চলে গেছে। এখন স্ত্রীর একার আয়ে সংসার চলে। তিনি বলেন, ‘বাসাভাড়াটা মাসের শুরুতে দিয়ে দেই। এরপর খাইলে খাইলাম, না খাইলে নাই।’