ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে লুটের ঘটনার তদন্তে অনীহা
নিলামে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কার্যাদেশ দেওয়ার আগেই গত এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মালামাল লুটের ঘটনা ঘটে।
সরকারি মালামাল লুট হওয়ার ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেই দায় এড়িয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। পাঁচ মাস আগে পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার কমিউনিটি সেন্টারে মালামাল লুটের ঘটনা ঘটেছিল। লুট হওয়া মালামালের দর ছিল প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। এ ঘটনায় অভিযোগের তির ছিল স্থানীয় কাউন্সিলরের অনুসারীদের দিকে।
প্রায় ১০ বছর ধরেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল তিনতলাবিশিষ্ট মৌলভীবাজার কমিউনিটি সেন্টার। দক্ষিণ সিটির ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের বেচারাম দেউড়ি এলাকায় এর অবস্থান। এটি ভেঙে বহুতল ভবনের পরিকল্পনা নেয় দক্ষিণ সিটি। এরই ধারাবাহিকতায় ভবনটি চলতি বছরের মার্চ মাসে নিলামে তোলা হয়। তবে নিলামে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কার্যাদেশ দেওয়ার আগেই গত এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মালামাল লুটের ঘটনা ঘটে।
নিকট অতীতে নিলামে ওঠা করপোরেশনের মালামাল লুট হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, এ ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির নাম আসায় বিব্রত হয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
মালামাল লুট হওয়ার পর অবশ্য সংস্থার সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে চকবাজার থানায় গত ২২ এপ্রিল জিডি করা হয়। এর আগে সরেজমিন পরিদর্শন করে কী ধরনের মালামাল লুট হয়েছে, তার একটি তালিকা তৈরি করা হয়। গত ২০ এপ্রিল সরেজমিন পরিদর্শন করে দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তারা দেখতে পান, কমিউনিটি সেন্টারের মধ্যে থাকা অন্তত ৮৩টি জানালা, ফটক, বারান্দার গ্রিল ইত্যাদি খোয়া গেছে। তবে ওই প্রতিবেদনে কে বা কারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত—এ বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি।
জিডির অগ্রগতি বিষয়ে জানতে গত ১৭ আগস্ট বিকেলে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাইয়ুমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। এ সময় তিনি খোঁজ নিয়ে জানানোর কথা বলেন। পরে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
দক্ষিণ সিটির সম্পত্তি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নিলামে সরকারি দাম ধরা হয় প্রায় ১ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। এতে সর্বোচ্চ দরদাতা হয় রাইডা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা কর বাদে প্রায় ৭ লাখ ৭৮ হাজার দাম হাঁকে। প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যাদেশ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান থাকা অবস্থায় লুটের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত না করেই স্থাপনাটি আবারও নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। নতুন করে পুরো স্থাপনাটির দর ৯৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, কমিউনিটি সেন্টারের মূল ফটকে তালা ঝুলছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের নিচতলায় একটি কক্ষে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মীদের সরঞ্জাম রাখা আছে। আরেকটি কক্ষে শোয়ার বিছানা ও জামাকাপড় ঝুলতে দেখা গেছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটির একাংশে এখনো নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কার্যক্রম চলছে।
ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাটির নিলাম আহ্বান করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটির সম্পত্তি বিভাগ। করপোরেশনের সব সম্পত্তির দেখভালের দায়িত্ব এই বিভাগই পালন করে। মালামাল লুটের পর দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে—এমন প্রশ্নে সংস্থার প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, আমরা জিডি করে সমাজকল্যাণ বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছি। সম্পত্তি বিভাগের কাজ তো তদন্ত করা নয়।
কিন্তু সম্পত্তির মালিক তো সম্পত্তি বিভাগই, এমন প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, কমিউনিটি সেন্টারের দায়িত্ব তো সমাজকল্যাণ বিভাগের ছিল। তারা মামলা করবে।
এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটির প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন নতুন করে ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়, তখন তো আমাদের তত্ত্বাবধানে থাকে না। অবস্থা বুঝে ওটা সম্পত্তি বিভাগ বা প্রকৌশল বিভাগে চলে যায়।’ তবে এই কর্মকর্তা এ–ও বলেন, তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করেছেন। সম্পত্তি বিভাগে এই ফাইল দেওয়া হয়েছে।
আবার প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আইন অনুযায়ী আমার যেভাবে নথি দেওয়ার কথা, সেভাবেই দিয়েছি।
নিলামে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য অনুযায়ী, ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মদ আলমগীর নিলামে তাঁর অনুসারীদের দিয়ে ভবনটির কাজ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাউন্সিলরের অনুসারীদের প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা হয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে কাউন্সিলর তাঁর ওয়ার্ডের কাজ অন্যরা কীভাবে নেয়, এ বিষয়ে হুমকিও দিয়েছিলেন বলে জানান সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ঘটনার সঙ্গে ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সম্পৃক্ত বলেও তাঁরা জানান। তবে কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মদ আলমগীর প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘মালামাল চুরির সঙ্গে তাঁকে জড়িয়ে কে কী বলল, তাতে তাঁর কিছু আসে যায় না।’