শিল্পকলা একাডেমি
নম্বরপত্র ঘষামাজা করে নিয়োগ পেলেন ২৫ জন
মহাপরিচালকের ঘনিষ্ঠ আটজন নিয়োগ পান, যাঁদের মধ্যে সাতজনই পরীক্ষায় পাস করেননি। তদন্তে প্রমাণ মিললেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
শিল্পকলা একাডেমিতে কালচারাল অফিসার পদে চাকরির জন্য লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন হাসান মাহমুদ। ২০০ নম্বরের মধ্যে পরীক্ষায় পাস নম্বর ১০০। কিন্তু হাসান মাহমুদ পান ৭৪। মোট ৩২৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে তাঁর মেধাক্রম ছিল ১৯৮তম। অকৃতকার্য হলেও পরে নম্বরপত্র ঘষামাজা করে তাঁকে নম্বর দেওয়া হয় ১২৬। এভাবে মেধাক্রমে দ্বিতীয় হয়ে চাকরি পান তিনি।
হাসান মাহমুদের মতো শিল্পকলার একাডেমির বিভিন্ন পদে লিখিত পরীক্ষায় ফেল করা ৪২ জনের নম্বরপত্র পরিবর্তন করে কৃতকার্য দেখানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ২৫ জন চাকরিতে যোগ দেন। এ নম্বরপত্র পরিবর্তনের পর তাতে পরীক্ষা কমিটির প্রধানের যে সই দেওয়া হয়, সেটাও ছিল জাল।
এ অনিয়মের সঙ্গে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীও জড়িত বলে অভিযোগ আছে। তাঁর পরিচালিত লোক নাট্যদলের আটজন সদস্য নিয়োগ পেয়েছেন, যাঁদের মধ্যে সাতজনই লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলেন বলে একাডেমির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে জানান। একই সূত্র জানায়, এসব নিয়োগের নেপথ্যে আর্থিক লেনদেনেরও ঘটনাও রয়েছে বলে শিল্পকলা একাডেমিতে আলোচনা আছে।
■ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছিল ৫৫ জনের ■ নিয়োগ পান ৪৬ জন ■ নম্বরপত্র ঘষামাজা ৪২ জনের, তাঁদের মধ্যে চাকরি পান ২৫ জন
২০১৭ সালের এ নিয়োগ নিয়ে গত বছর সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত প্রতিবেদনেও এ নিয়োগের নানা অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। গত বছর ১৯ জুলাই এ প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে জমা পড়ে। কিন্তু পরে এটা ধামাচাপা পড়ে যায়।
জানা যায়, ২০১৫ সালে ১৯টি ক্যাটাগরিতে মোট ৫৫ পদের বিপরীতে জনবল নিয়োগের জন্য চারটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে শিল্পকলা। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বিভিন্ন পদে কয়েক ধাপে আবেদনকারীদের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদকে।
নিয়োগসংক্রান্ত কাগজপত্র ও তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল জমা দেওয়া হয়েছিল একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলীর কাছে। পরে এ ফল পরিবর্তন হয়ে যায়। অকৃতকার্য হওয়া মোট ৪২ জনের পরীক্ষার নম্বর পরিবর্তনের প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি।
লিয়াকত আলী পরিচালিত লোক নাট্যদলের যে সাতজনের নম্বরপত্র ঘষামাজা করা হয়েছে, সেটার প্রমাণও তদন্ত কমিটি পেয়েছে। প্রতিবেদনে সেটা বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়।
এর মধ্যে কণ্ঠশিল্পী পদে রোকসানা আক্তার ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় পেয়েছিলেন ২২, মেধাক্রম ছিল ৭৩। নম্বর পরিবর্তন করে ৬৬ করা হয়, তখন মেধাক্রম হয়ে যায় ৩। একই পদে আবদুল্লাহেল রাফীকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। লিখিত পরীক্ষায় তিনি পেয়েছিলেন ২৮। তা পরিবর্তন করে ৬৭ করা হয়। সোহানুর রহমান পেয়েছিলেন ৩৭। জালিয়াতি করে তাঁর নম্বর বাড়িয়ে করা হয় ৬২। সুচিত্রা রানী সূত্রধর ১০০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছিলেন ১৫। তাঁর নম্বর পরিবর্তন করে দেওয়া হয় ৬৪।
গাইড লেকচারার পদে মাহবুবুর রহমান লিখিত পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছিলেন ৭৫। পরে নম্বর পরিবর্তন করে তাঁকে দেওয়া হয় ১০০। নৃত্যশিল্পী রুহী আফসানার প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৩৪। তাঁর নম্বর অবশ্য পরিবর্তন না করে নারী কোটায় তাঁকে নিয়োগ দেখানো হয়। ক্যামেরাম্যান পদে রুবেল মিয়া ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় পেয়েছিলেন ১২। এটি পরিবর্তন করে তাঁকে দেওয়া হয় ৮৫ নম্বর।
অনিয়মের এখানেই শেষ নয়, লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর বাছাই কমিটি সভা করে ১৯টি ক্যাটাগরির মধ্যে আটটিতে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সবার ব্যবহারিক পরীক্ষা নেয়। এরপর লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। এটা নিয়মবহির্ভূত বলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোর কাছে মন্তব্য করেন।
একই সূত্র জানায়, এই নিয়োগের বাছাই কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন শিল্পকলার মহাপরিচালক লিয়াকত আলী। পছন্দের প্রার্থীরা লিখিত পরীক্ষা পাস না করায় তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
শিল্পকলা সূত্রে জানা গেছে, ৫৫ পদের বিপরীতে সুপারিশপ্রাপ্তদের মধ্যে ৪৬ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, বাকি ৯ জনকে নিয়োগ না দেওয়ার কারণ, ওই সব পদে মহাপরিচালকের পছন্দের কর্মকর্তারা অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন।
নিয়োগে এসব অনিয়ম ও জালিয়াতির বিষয়ে শিল্পকলা একাডেমির জনসংযোগ কর্মকর্তা হাসান মাহমুদের মাধ্যমে মহাপরিচালক লিয়াকত আলীর বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। জবাবে তিনি বলেন, সরকারের সব বিধিবিধান মেনে যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়োগগুলো সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ করে পরীক্ষার ফলাফল সিলগালা করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। পরে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পরিষদ কর্তৃক অনুমোদনের প্রেক্ষিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এখানে মহাপরিচালকের একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিংবা হস্তক্ষেপের অবকাশ নেই।
তবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসেছে, লিখিত পরীক্ষার যে ফলাফল সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে পাঠানো হয়েছে, সেটা পরে পরিবর্তন করা হয়েছে। লিখিত পরীক্ষা কমিটির প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের তৎকালীন ডিন (বর্তমানে সিলেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) ফরিদ উদ্দিন আহমেদ তদন্ত কমিটিকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, সংযুক্ত নম্বরপত্রগুলোতে তাঁর যে সই আছে, তা নকল। তিনি লিখিত পরীক্ষার যে ফলাফল শিল্পকলায় পাঠিয়েছেন, তার বাইরে কোনো সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিমার্জনের সঙ্গে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের কোনো সম্পর্ক নেই।
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি ও পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের তৎকালীন সহকারী অধ্যাপক দেবপ্রসাদ যুক্ত ছিলেন। তিনি তদন্ত কমিটিকে জানান, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে নিয়োগ, লিখিত পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল তাঁর পাঠানো খসড়া ফলাফলের সঙ্গে মিল নেই।
প্রতিবেদন পেয়ে চুপ সচিব
এ নিয়োগ নিয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ২০২১ সালের ১৯ জুলাই মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুরের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর ছয় মাস পার হলেও এ নিয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, তদন্ত প্রতিবেদন ধাপাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সচিব মো. আবুল মনসুরের সঙ্গে এই প্রতিবেদক ফোনে যোগাযোগ করেন। তিনি প্রশ্ন শুনে রেগে যান। কোনো কথা বলেননি।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শওকত আলী। বাকি দুই সদস্য ছিলেন শিল্পকলা একাডেমির তৎকালীন সচিব নওসাদ হোসেন ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোসাম্মৎ জোহরা খাতুন। কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘উদ্দেশ্য ভালো থাকলে কেউ এই তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা দিয়ে রাখত না। এত বড় অনিয়মের তথ্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে আরও আগে জানানো উচিত ছিল।’