ঢাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব
থাকার কথা ১২০ জন, থাকেন ৩৯১ জন
ঢাকার লালবাগ ও চকবাজারের জনঘনত্ব প্রতি একরে ৬০০-৭০০ জন।
ভারতের চেন্নাইতে জনঘনত্ব ১০১, দিল্লিতে ৯৩ জন।
একটি বড় শহরের বাসযোগ্যতা অনেকাংশে নির্ভর করে সেখানে একরপ্রতি কতজন মানুষ থাকে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হচ্ছে, একরপ্রতি ৭০ থেকে ৮০ জন। ক্ষেত্রবিশেষে তা ১২০ জন পর্যন্ত হতে পারে। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরে প্রতি একরে বাস করেন ৩৯১ জন। জনসংখ্যার এই চাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা বাড়বে না, নাগরিকেরাও তাঁদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা পাবেন না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ড (উত্তরা) এলাকার অবকাঠামো ও নাগরিক সেবার বর্তমান অবস্থা অনুযায়ী প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাস করতে পারবে। কিন্তু সেখানে অতিরিক্ত প্রায় ৮৫ হাজার মানুষ বাস করে। অতিরিক্ত মানুষের কারণে উত্তরাতে হাসপাতাল বা ক্লিনিক, পার্ক, খেলার মাঠ—প্রতিটিই প্রয়োজনের তুলনায় কম; যেগুলো একটি শহরের বাসযোগ্যতার সঙ্গে জড়িত। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ জরুরি বলে মনে করে বিআইপি।
ভবনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ, ভবনপ্রতি পরিবারের সংখ্যা এবং উন্মুক্ত স্থান রাখা—এই তিন পদ্ধতির মাধ্যমে জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ঢাকা শহরের জনঘনত্ব, বাসযোগ্যতা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিআইপির ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নগর–পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, অস্ট্রেলিয়ায় সিডনি শহরের সর্বোচ্চ জনঘনত্ব প্রতি একরে ৫৮ জন। নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটনের জনঘনত্ব ১১২ জন। ভারতের চেন্নাইতে জনঘনত্ব ১০১, দিল্লিতে ৯৩। অনেক বড় শহরের তুলনায় ঢাকার লালবাগ ও চকবাজারের জনঘনত্ব প্রতি একরে ৬০০-৭০০ জন। তিনি বলেন, ঢাকাকে বসবাস-অযোগ্যতার হাত থেকে বাঁচাতে হলে জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পাকিস্তান আমলে জনঘনত্ব একরপ্রতি ৬৫ ধরে ধানমন্ডিতে প্লট হস্তান্তর করা হয়েছিল। প্লট হস্তান্তরের দলিলে উল্লেখ ছিল প্লটের কী পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে। ওই সময় ধানমন্ডিতে ২-৩ তলা ভবন করা যেত, এখন ১৪ তলা করা যায়। বর্তমানে ধানমন্ডিতে একরপ্রতি ৪০০ জনের বেশি মানুষ বাস করে।
যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদন (২০১৯ সাল) অনুযায়ী, বাসযোগ্যতার বিচারে খারাপ অবস্থার দিক থেকে ঢাকার অবস্থান ১৩৮তম। ঢাকার পরের দুটি শহরের একটি নাইজেরিয়ার লাগোস, অন্যটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্ক।
দেরিতে হলেও সরকার ঢাকার জনঘনত্বের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা করতে যাচ্ছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) ‘জনঘনত্ব বিন্যাস’ নামে একটি কর্মকৌশল যুক্ত করা হয়েছে। যাতে এলাকাভিত্তিক আবাসিক ভবনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। আবাসন ব্যবসায়ীসহ নগরবাসীর একটি অংশ আবাসিক ভবনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত কর্মকৌশল বা পরিকল্পনার সমালোচনা করছে। অনেকেই বলছে, ঢাকা শহরে জমির তুলনায় মানুষ বেশি, অধিক মানুষের আবাসন নিশ্চিত করতে আবাসিক ভবনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ না করে আরও বাড়াতে হবে।
বিআইপি বলছে, ভবনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ করেও ঢাকা মহানগরে আরও অনেক মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব। সংবাদ সম্মেলনে রাজউকের এক জরিপের বরাত দিয়ে জানানো হয়, রাজউক এলাকায় মোট স্থাপনার ৮৪ শতাংশ এখনো একতলা। তিনতলা উঁচু স্থাপনা মোট স্থাপনার ৯৩ শতাংশ। এ ছাড়া রাজধানীর পূর্ব অংশ, উত্তরা তৃতীয় পর্ব এবং ঝিলমিল প্রকল্প এলাকা এখনো ফাঁকা।
ভবনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ, ভবনপ্রতি পরিবারের সংখ্যা এবং উন্মুক্ত স্থান রাখা—এই তিন পদ্ধতির মাধ্যমে জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করা যায় বলে জানান বিআইপির সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। তিনি বলেন, জনঘনত্ব, শহরের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এলাকাভিত্তিক জনঘনত্বের মানচিত্র তৈরি করা, এলাকাভিত্তিক সামাজিক, নাগরিক সুবিধা ও অবকাঠামোর তালিকা প্রস্তুত করা এবং সেই অনুযায়ী ‘ডেভেলপমেন্ট পারমিট’ (উন্নয়ন অনুমোদন) দেওয়া।
আগের পরিকল্পনা এবং আইন ও বিধিমালাগুলোয় জনঘনত্ব বিষয়টির যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ায় ঢাকা শহরের জনসংখ্যা অত্যধিক বেড়ে গেছে বলে মনে করেন নগর–পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ ফজলে রেজা। তিনি বলেন, যে কারণে শহরে গণপরিবহন, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে।