ঢাকা ওয়াসা
‘চলতি’ ও ‘অতিরিক্তই’ ১৬৩ জন
রাজস্ব, প্রশাসন, হিসাব ও প্রকৌশল শাখার অন্তত ১৬৩ জন কর্মকর্তা চলতি অথবা অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন।
৩৫ জন পাম্পচালককে রাজস্ব পরিদর্শকের চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এস এম মোস্তফা কামাল মজুমদারকে ২০১৯ সালের মে মাসে প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুই বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এই পদে রয়েছেন। অথচ ওয়াসার নিজস্ব চাকরি প্রবিধানমালা অনুযায়ী, এই পদে একজন প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালনের সুযোগ নেই।
প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার মতোই ১৬ মাসের বেশি সময় ধরে ঢাকা ওয়াসার সচিব পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন শারমিন হক আমীর। তিনি ওয়াসার একজন নির্বাহী প্রকৌশলী। সরকারি চাকরি আদেশ অনুযায়ী, চলতি বা অতিরিক্ত দায়িত্ব দুই মাসের বেশি হলে ওয়াসা বোর্ডের অনুমোদন লাগবে। কিন্তু দীর্ঘ সময় অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকলেও এ ক্ষেত্রে ওয়াসার বোর্ডের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
শুধু এই দুটি পদ নয়, ঢাকা ওয়াসার উচ্চ থেকে নিম্ন শ্রেণির বেশ কিছু পদ দীর্ঘদিন ধরে চলতি ও অতিরিক্ত দায়িত্বে চলছে। প্রথম আলোর কাছে আসা তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব, প্রশাসন, হিসাব ও প্রকৌশল শাখায় অন্তত ১৬৩ জন কর্মকর্তা চলতি অথবা অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এবং সচিবের মতো পদগুলো বছরের পর বছর অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে চালানো হচ্ছে।
বছরের পর বছর অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে চালানো হচ্ছে। দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ওয়াসার চাকরি প্রবিধানের ব্যত্যয় ঘটার অভিযোগ
এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী, রাজস্ব কর্মকর্তা, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও সহকারী সচিব পদও অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে চলছে। এসব দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ওয়াসার চাকরি প্রবিধানের ব্যত্যয় ঘটার অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতিরিক্ত ও চলতি দায়িত্বের বিষয়টি নিয়ে বোর্ড অবহিত নয়। কতজন এ রকম দায়িত্বে আছে, তা–ও জানি না। দু-চারটি ঘটনা জানার পর বিগত বোর্ড সভায় বলেছিলাম, এত চলতি আর অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকার কারণ কী? ওয়াসা কর্তৃপক্ষ কোনো জবাব দেয়নি। পুরো চিত্র জানতে পারলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ঢাকা ওয়াসার প্রবিধানমালা মতে, সচিব ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পেতে হলে যথাক্রমে উপসচিব পদে ও উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা পদে ৭ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা এবং প্রথম শ্রেণির পদে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথচ এই দুই পদে এখন যে দুজন কর্মকর্তা দায়িত্ব (অতিরিক্ত) পালন করছেন, তাঁরা কেউই এর আগে প্রশাসন কিংবা রাজস্ব বিভাগে কাজ করেননি। এই দুটি পদে পদোন্নতি যোগ্য প্রার্থী না থাকলে উপসচিব পদের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান রয়েছে।
ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বেশ কিছু পদে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে শূন্য পদ পূরণের বিধান আছে। কিন্তু ঢাকা ওয়াসাতে যেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন না হয়, সে চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। ওয়াসার নিজস্ব প্রবিধান না মেনে বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খেয়ালখুশিমতো চলতি ও অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। তিনি ২০০৯ সাল থেকে এমডি পদে থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না। ফলে কোনো কর্মকর্তা এসব বিষয় নিয়ে কথা বললেই তাঁকে চাপে পড়তে হয়।
ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদ দুটিতে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া নিয়েও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। জ্যেষ্ঠতার ক্রমে ছয় ও সাতজনকে ডিঙিয়ে কামরুল হাসানকে প্রধান প্রকৌশলী এবং আখতারুজ্জামানকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। কামরুল হাসান প্রধান প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন ২০১৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে।
২০০৯ সালে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের জন্য প্রণীত চাকরি (বেতন ও ভাতাদি) আদেশে বলা হয়েছে, চলতি দায়িত্বের পরিবর্তে পদোন্নতির মাধ্যমে শূন্য পদ পূরণকে উৎসাহিত করতে হবে। চলতি বা অতিরিক্ত দায়িত্বকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। চলতি ও অতিরিক্ত দায়িত্বের স্থায়িত্ব দুই মাসের বেশি হলে বিষয়টি দুই মাসে অতিক্রমের আগেই সংশ্লিষ্ট কমিটি বা বোর্ডের অনুমোদন লাগবে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পানি সরবরাহ) মুহম্মদ ইবরাহিম প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াসার সচিব ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারের জন্যই নির্ধারিত। কিন্তু অনেক সময় জনপ্রশাসন থেকে লোকবল দিতে না পারায় ওয়াসার নিজস্ব লোকদের দিয়ে চালানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রবিধানমালার শর্ত পূরণ না হওয়ায় নিয়মিত দায়িত্ব দিতে পারে না।
তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরাও চলতি দায়িত্বে
সমপদের শূন্যতা চলতি দায়িত্বের মাধ্যমে পূরণের বিধান নেই। ঢাকা ওয়াসার প্রবিধানমালা ও সাংগঠনিক কাঠামো মতে, পাম্পচালক ও রাজস্ব পরিদর্শক সম গ্রেডের ও সম স্কেলের পদ। কিন্তু ঢাকা ওয়াসায় ৩৫ জন পাম্পচালককে রাজস্ব পরিদর্শকের চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দুই বছর ধরে এসব পাম্পচালক রাজস্ব বিভাগে রাজস্ব আদায়ের কাজ করছেন।
গত ২৭ এপ্রিল থেকে ছুটিতে যুক্তরাষ্ট্রে যান তাকসিম এ খান। এখনো তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই অবস্থান করছেন। অতিরিক্ত ও চলতি দায়িত্ব প্রসঙ্গে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে প্রশ্ন পাঠানো হয়। তিনি সেটি দেখলেও কোনো উত্তর দেননি।
পরে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হলে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের হয়ে জবাব দেন সংস্থার উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেক। তাতে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। ঢাকা ওয়াসা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত সেবামূলক বাণিজ্যিক সংস্থা এবং এটি করপোরেট ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। ঢাকা ওয়াসায় নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি বা ঘটছে না। এ সংস্থার সব কর্মকাণ্ড বিধান মেনেই করা হয়।
এমডির সরাসরি তত্ত্বাবধানে থাকা জনসংযোগ বিভাগের সর্বোচ্চ পদ উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তার এই পদটিও অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে চালানো হচ্ছে। মোস্তফা তারেক মূলত প্রশিক্ষণ বিভাগের একজন যুগ্ম প্রধান প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা। এই পদটি সহকারী জনতথ্য কর্মকর্তার পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করার কথা।
সরকারি চাকরির বিধিবিধান বিশেষজ্ঞ সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রবিধানে এক রকম থাকবে আর কাজ করবে অন্য রকম, সেটি আইনসম্মত নয়। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ যদি জনবল চেয়ে চিঠি না লেখে, তাহলে মন্ত্রণালয়ের তো বিষয়টি জানার কথা নয়। পছন্দের লোক বিভিন্ন জায়গায় বসানোর জন্য ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এই কাজ করতে পারে। অতিরিক্ত ও চলতি দায়িত্বে অনিয়মের বিষয়ে ওয়াসা বোর্ড ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে পারে।