গন্তব্যে যেতে ভরসা রিকশা–অটোরিকশা বা নিজের গাড়ি
আজ সোমবার সকাল ছয়টা থেকে শুরু হয়েছে লকডাউন। রাজধানীতে অন্যান্য দিনের তুলনায় সকাল থেকে যান চলাচল ছিল অনেকটা কম। সড়কে গণপরিবহন (বাস) দেখা যায়নি। তবে সড়কজুড়ে রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার আধিক্য ছিল। ব্যক্তিগত গাড়িও চলতে দেখা গেছে। মার্কেট বা শপিং মলগুলো ঘোষণা অনুযায়ী বন্ধই আছে।
তবে কিছু কিছু এলাকায় লেগুনায় যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। যে বাসগুলো চলছে, তা কোনো না কোনো অফিসের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়।
মিরপুর সাড়ে ১১ থেকে থেকে সেগুনবাগিচায় অফিসের উদ্দেশে আজ একটু আগেভাগেই বাসা থেকে বের হন নিয়াজ মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘লকডাউনের প্রথম দিন আজ। অফিসে কীভাবে যাব, তা নিয়ে একটু সংশয় ছিল। এ কারণে আগেই বাসা থেকে বের হয়েছি।’ যেতে সমস্যা হয়েছিল কি না, তা জানতে চাইলে নিয়াজ বলেন, ‘না, সমস্যা হয়নি। বরং সড়কে গাড়ি চলাচল কম থাকায় অফিসে নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌঁছে গিয়েছি। সিএনজিতে আসায় খরচটা বেশি পড়েছে।’ নিয়াজ জানান, তাঁর বাসার কাছে কয়েকটি জায়গায় বরাবরের মতো মোটরসাইকেল নিয়ে কিছু যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। তাঁরা ‘খ্যাপে’ যাত্রী নেন।
খিলগাঁওয়ের সাবরিনা হকের অফিস বাংলামোটরে। এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বাসা থেকে অফিসে এসেছেন রিকশায়। তিনি বললেন, ‘লকডাউনের তেমন কোনো প্রভাব দেখলাম না। সড়কে বাস নেই। এ ছাড়া সবই তো আগের মতোই। যাঁরা অফিস করছেন, তাঁরা তো বাসা থেকেই বের হয়েছেন।’ তাঁর মতে, ‘সীমিত’ অফিসের ধারণাটা স্পষ্ট নয়। অফিস খোলা থাকলে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রয়োজন হয়। কেননা, কোনো অফিসই অতিরিক্ত লোক নিয়ে চলে না।
রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোয় ভিড় রয়েছে। তবে অন্যান্য দিনের তুলনায় ভিড় কিছুটা কম।
কারওয়ান বাজারের সোনারগাঁও মোড়ে দায়িত্ব পালনরত ট্রাফিক কনস্টেবল জানান, লকডাউনের প্রথম দিন আজ। এ কারণে অনেকেই যাতায়াতের বিষয়টি বুঝতে পারছেন না। প্রধান সড়কে তাই রিকশা বেশি। যাঁরা বাসে চলাচল করতেন, তাঁরা রিকশায় উঠেছেন।
কুড়িল থেকে ফার্মগেট এলাকায় এসেছেন ইকবাল মাহমুদ। ব্যক্তিগত গাড়িতে এসেছেন। তিনি জানান, সড়কে যানবাহনের চাপটা অনেক কম। এ কারণে আসতে কম সময় লেগেছে। তিনি আরও জানান, মানুষ তো বাইরে বের হচ্ছে। এতে লকডাউনের উদ্দেশ্য কতটা কার্যকর হবে, সেটা নিয়ে তাঁর সন্দেহ রয়েছে।
মিরপুর এলাকার ৬০ ফিট সড়কে কিছু লেগুনা চলতে দেখা গেছে। এসব লেগুনায় ১০ থেকে ১২ জন করে যাত্রী উঠছেন। লেগুনার একজন চালক বলেন, বের হয়েছেন। না হলে আয় হবে কীভাবে। এই লেগুনায় ওঠা এক যাত্রী বললেন, ‘কাজ তো বন্ধ নেই। কোনো না কোনোভাবে কর্মস্থলে যেতেই হবে। সুরক্ষার জন্য সিএনজিতে চলাচল করা তো সবার পক্ষে সম্ভব না। আর সবার অফিস গাড়ির ব্যবস্থা করবে—এমনটা তো নয়।’
এখন থেকে প্রায় ১৩ মাস আগে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল। তখন পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুতই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল সরকার। গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া সেই ছুটি ৬৬ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। এক বছর পর সংক্রমণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আবারও একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারকে।
এ সময় মানুষের কাজ ও চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকবে। জরুরি সেবা ছাড়া প্রায় সবকিছুই বন্ধ থাকবে। চলবে না কোনো গণপরিবহন। অভ্যন্তরীণ পথে উড়বে না উড়োজাহাজও।
তবে লকডাউনের মধ্যেও জরুরি কাজের জন্য সীমিত পরিসরে অফিস খোলা থাকছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব ব্যবস্থায় কর্মীদের অফিসে আনা-নেওয়ার কথা বলেছে সরকার। একইভাবে শ্রমিকদের আনা-নেওয়ার শর্তে শিল্পকারখানা ও নির্মাণকাজ চালু রাখা যাবে। এ রকম নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে গতকাল রোববার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। অবশ্য প্রজ্ঞাপনে ‘লকডাউন’ (অবরুদ্ধ অবস্থা) শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। যদিও গতকাল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ ছুটির এই সাত দিনকে ‘লকডাউন’ বলেছেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে মোট ১১টি নির্দেশনার কথা বলা হয়েছে। সারা দেশে জেলা ও মাঠ প্রশাসন এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিত টহল জোরদার করবে। নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। গত বছর সাধারণ ছুটির সময় সংক্রমণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সশস্ত্র বাহিনী নামানো হয়েছিল।
যা বন্ধ, যা খোলা
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, শর্ত সাপেক্ষে আজ সকাল ৬টা থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত সার্বিক কার্যাবলি ও চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ সময় সব ধরনের গণপরিবহন (সড়ক, রেল, নৌ, অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট) বন্ধ থাকবে। তবে পণ্য পরিবহন, উৎপাদনব্যবস্থা ও জরুরি সেবার ক্ষেত্রে এই আদেশ প্রযোজ্য হবে না। বিদেশগামী ও বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না।
তবে কারও স্বজন বিদেশ থেকে এলে বা বিদেশে যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে গাড়ি নিয়ে গেলে বাধার মুখের পড়বে কি না, তা প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়নি।
প্রজ্ঞাপনে আইনশৃঙ্খলা ও জরুরি সেবা, যেমন: ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস বা জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরগুলোর (স্থলবন্দর, নদীবন্দর ও সমুদ্রবন্দর) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট, ডাকসেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিস ও তাদের কর্মচারী ও যানবাহন নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে।
আদেশে বলা হয়, সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও আদালত এবং বেসরকারি অফিস শুধু জরুরি কাজের জন্য সীমিত পরিসরে প্রয়োজনীয় জনবলকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় অফিসে আনা-নেওয়া করতে পারবে। শিল্পকারখানা ও নির্মাণকাজও চলবে। শিল্পকারখানার শ্রমিকদের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আনা-নেওয়া করতে হবে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএকে শ্রমিকদের জন্য শিল্পকারখানা এলাকায় ‘ফিল্ড হাসপাতাল’ বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
সশস্ত্র বাহিনী বিভাগও ঢাকায় সুবিধাজনক জায়গায় ‘ফিল্ড হাসপাতাল’ স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত অতি জরুরি কাজ (ওষুধ কেনা, নিত্যপণ্য কেনা, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন বা সৎকার ইত্যাদি) ছাড়া কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে যাওয়া যাবে না। খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় শুধু খাবার বিক্রি ও সরবরাহ করা যাবে। কোনো অবস্থাতেই হোটেল-রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া যাবে না।
শপিং মলসহ অন্যান্য দোকান বন্ধ থাকবে। তবে পাইকারি ও খুচরা পণ্য অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই কর্মচারীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং কোনো ক্রেতা সশরীর যেতে পারবেন না।
সরকারি আদেশে বলা হয়েছে, কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত খোলা জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাবেচা করা যাবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা সীমিত পরিসরে চালু থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, নতুন সময় অনুযায়ী সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ব্যাংকিং লেনদেন চলবে। লেনদেন-পরবর্তী আনুষঙ্গিক কার্যক্রম শেষ করার জন্য ব্যাংক খোলা থাকবে বেলা দুইটা পর্যন্ত। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
লকডাউনে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারিক কার্যক্রম সীমিত পরিসরে ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতিতে পরিচালিত হবে। জামিনসহ সব ধরনের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের কার্যকারিতা দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বৃদ্ধি হওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে। এ ছাড়া চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কার্যক্রম সীমিতভাবে চলবে। আর এই সময়ে অন্যান্য নিম্ন আদালতের কার্যক্রম না চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সংক্রমণ ঠেকাতে সাত দিনের সরকারি বিধিনিষেধ সম্পর্কে চিকিৎসাবিজ্ঞানী লিয়াকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমত, এটিকে ‘লকডাউন’ না বলে কঠোর বিধিনিষেধ বলাই সংগত মনে হয়। দ্বিতীয়ত, এখানে কিছু কিছু বিষয় অস্পষ্ট ও পরস্পরবিরোধী। কারণ, কিছু কিছু বিষয় খোলা রেখে গণপরিবহন বন্ধ থাকলে মানুষ সেসব জায়গায় যাবে কীভাবে? আবার শ্রমজীবী মানুষের জীবিকার কী হবে, সেটিও দেখতে হবে।