হোমায়রা আক্তারের বয়স পাঁচ বছর। ছোট ভাই মোহাম্মদ হামিমের বয়স তিন বছর। বাড়িতে স্বজনেরা যখন আহাজারি করছিলেন, ফ্যালফ্যাল করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল দুই ভাইবোন। তাদের মা মিতু আক্তার বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘আমার পোলাপাইনগুলোর (সন্তান) কী অইব? তারা কারে বাবা ডাকব?’
বাচ্চা দুটির বাবা মোহাম্মদ মুরসালিন ঢাকার নিউমার্কেটের একটি দোকানের কর্মচারী ছিলেন। তিনি গত মঙ্গলবার নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী ও কর্মীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। সকালে লাশ নিতে আসেন মুরসালিনের বড় ভাই নূর মোহাম্মদ। ভাইয়ের হত্যার ঘটনায় মামলা করবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা করে আর কী হবে? এই দেশে তো বিচার নাই। কারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে, সেটাও তো জানা নাই।’
গতকাল দুপুরে কামরাঙ্গীরচরের পশ্চিম রসুলপুরে মুরসালিনদের বাসার সামনে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর মা নূরজাহান বেগম আহাজারি করছেন। বলছিলেন, ‘আমার জোড়ের কইতর ভাইঙ্গা গেল। আমি তো কারও ক্ষতি করি নাই। আমার এত বড় সর্বনাশ কেন হলো? আমার বাবারে আমি এখন কই পামু?’
মুরসালিনের মা যখন বাসার সামনে বিলাপ করছিলেন, তাঁর স্ত্রী মিতু আক্তার তখন বাসার ভেতরে শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দুই সন্তানের কী হবে, এ নিয়েই তিনি আহাজারি করছিলেন।
স্বজন ও প্রতিবেশীরা জানান, বড় ভাই নূর মোহাম্মদের সঙ্গে মোহাম্মদ মুরসালিনের বয়সের পার্থক্য ১০ বছরের। দুই ভাই এক যুগের বেশি সময় ধরে ঢাকার নিউমার্কেট এলাকার দুটি বিপণিবিতানে চাকরি করে আসছেন। দুই ভাইকে মা নূরজাহান বেগম বলতেন, ‘জোড়ের কইতর (জোড়া কবুতর)।’
নূরজাহান বেগমের সঙ্গে যখন এই প্রতিবেদকের কথা হচ্ছিল, তখন তাঁর কোলে ছিল মুরসালিনের ছেলে হামিম। পাশে এক আত্মীয়ের কোলে বসা ছিল মুরসালিনের মেয়ে হোমায়রা। তখনো মুরসালিনের লাশ বাড়িতে পৌঁছায়নি। বাবাকে চিরতরে হারানোর বিষয়টি বাচ্চা দুটি পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না।
মুরসালিনের মা জানান, তাঁর স্বামী মানিক মিয়া পেশায় রিকশাচালক ছিলেন, মারা গেছেন আট বছর আগে। পরিবারটি ৪০ বছরের বেশি সময় আগে জীবিকার সন্ধানে কুমিল্লার তিতাস এলাকা থেকে ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে আসে। তাঁদের দুই ছেলের জন্ম এই এলাকাতেই। আর্থিক অনটনের কারণে বেশি দূর লেখাপড়া করাতে পারেননি।
‘আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম’
ছেলে হত্যার বিচার চান কি না, জানতে চাইলে নূরজাহান বেগম বলেন, ‘আমি কার কাছে বিচার দিমু, কে করবে বিচার? আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম। আল্লাহ তুমি বিচার কইরো।’
একই ঘটনায় মঙ্গলবার নিহত কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেনের মা নার্গিসও ছেলে হত্যার বিচার চান না বলে জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বিচার চাই না। নাহিদকে তো আর ফেরত পাব না। বিচার চেয়ে কী হবে। বিচার চাইলেই তো আর বিচার পাব না।’ গতকাল নাহিদের হত্যার ঘটনায় থানায় যে মামলা হয়েছে, সেটার বাদী তাঁর চাচা মো. সাইদ।
সংঘর্ষে পড়েই দুজনের মৃত্যু
মুরসালিনের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক হালদার অর্পিত ঠাকুর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুরসালিনের মাথায় লম্বায় ৪ ইঞ্চি এবং দেড় ইঞ্চি প্রশস্ত ক্ষত পাওয়া গেছে। এটাকে ‘ফাটা জখম’ লেখা হয় প্রতিবেদনে। তাঁর দুই চোখ এবং কপালের বাঁ পাশে ফোলা, বাঁ কান দিয়ে রক্ত ঝরেছে, মুখ ও ঠোঁট ফোলা।
সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মঙ্গলবার বেলা দেড়টার দিকে চন্দ্রিমা মার্কেটের সামনের রাস্তায় ব্যবসায়ী পক্ষ এবং ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে মুরসালিন মাথায় এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পান। পথচারীরা তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। দুই দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বৃহস্পতিবার ভোরে তিনি মারা যান।
এর আগে নিহত নাহিদ হোসেনের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নাহিদের মাথায় চারটি কাটা আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। মাথার ডান পাশে ২ ইঞ্চি জখম, পিঠের সাতটি স্থানে আঘাত। এর মধ্যে পাশাপাশি তিনটি কাটা জখম এবং প্রতিটি প্রায় ৫ ইঞ্চির মতো লম্বা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নাহিদ গত মঙ্গলবার ঢাকা কলেজের উল্টো পাশে নূরজাহান মার্কেটের সামনে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুরুতর আহত হন। পথচারীদের সহায়তায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই দিন রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
নাহিদের খালা মনিকা আক্তার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, নাহিদের মৃত্যুর পর পরিবারটি একবারে ভেঙে পড়েছে। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে পরিবারটির দিশাহারা অবস্থা। নাহিদের স্ত্রীর মুখের দিকে তাকানো যায় না। কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে।