এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কেন
সকাল ১০টার পরে আগারগাঁও থেকে খবর এল, ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকেরা বিক্ষোভ শুরু করেছেন। বন্ধ হয়ে গেছে যান চলাচল। এর আগে ভোরে খবর আসে, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক এনে শাহবাগে জড়ো করা হচ্ছে। দুপুরে যাত্রাবাড়ী থেকে খবর এল, সেখানে একটি কলেজে হামলা চলছে। বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকা–সিলেট মহাসড়ক। সন্ধ্যার পরপর জানা গেল, শাহবাগে শুরু হয়েছে মারামারি। সব মিলিয়ে গতকাল সোমবার রাজধানী ঢাকা ছিল একধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে।
এমন পরিস্থিতি কেবল গতকাল নয়, বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে, যা নগরের স্বাভাবিক জনজীবনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। ব্যবসা–বাণিজ্য ও অবাধ চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় আটকে যাচ্ছে। হঠাৎ কোনো কোনো জায়গায় বিক্ষোভ–সংঘর্ষ ঘটনাস্থলে থাকা সাধারণ মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে।
নানা দাবিদাওয়া নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই মাঠে নামছে কোনো না কোনো সংগঠন। তুচ্ছ কারণেও মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর আশপাশের শিল্প এলাকাগুলোতে পোশাকশ্রমিকেরা প্রায়ই বিক্ষোভে নামছেন, অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো সহিংস হয়ে উঠছে। এখন সর্বত্র আলোচনা, কেন এমনটা হচ্ছে। এর পেছনে কারও উসকানি রয়েছে কি না। সংঘবদ্ধভাবে বিভিন্ন ব্যানারে রাস্তায় নেমে যখন–তখন সড়কে অচলাবস্থা তৈরি করা হচ্ছে; সবই ন্যায্য দাবিতে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন নাকি অন্য উদ্দেশ্যও আছে?
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর জেরে গত রোববার ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ব্যাপক হামলা–ভাঙচুর করেন ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাঁদের সঙ্গে যাত্রাবাড়ী–ডেমরা এলাকার আরও কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীও ছিল বলে জানা যায়। তাঁরা পার্শ্ববর্তী সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজ ও কবি নজরুল কলেজেও হামলা–ভাঙচুর করেন। কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষে পুরান ঢাকার ওই এলাকায় এক ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এই হামলার জেরে গতকাল যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল এলাকার মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে পাল্টা হামলা করেছেন কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্ররা। পুরান ঢাকা থেকে শত শত তরুণ লাঠিসোঁটা নিয়ে ৫–৬ কিলোমিটার দূরে আরেকটি কলেজে গিয়ে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করলেন। কোথাও তাঁদের থামানো হলো না বা থামানো গেল না!
পরে হামলাকারীদের প্রতিহত করার জন্য মাহবুবুর রহমান কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় লোকজনও। পুরো এলাকা অনেকটা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ একটা সড়ক বন্ধ ছিল বিকেল পর্যন্ত।
বেলা ৩টা ২২ মিনিটে সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘শত চেষ্টার পরেও, বসে সমাধান করার আহ্বান জানানোর পরেও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে জড়ানো থেকে আটকানো গেল না। অ্যাগ্রেসিভনেস ও প্রস্তুতি দেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও স্ট্রিক্ট অ্যাকশনে যায়নি। কোনো প্রকার অ্যাকশনে গেলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ ও রক্তপাত হতো। সব পক্ষকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানাচ্ছি। একত্রে দেশ গড়ার সময়ে সংঘর্ষের মতো নিন্দনীয় কাজে জড়ানো দুঃখজনক। এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ছোটখাটো ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক কলেজের শিক্ষার্থীর আরেক কলেজে হামলার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে আরও ঘটেছে। ঢাকা কলেজের সঙ্গে সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েক দফা হামলা ও সংঘর্ষ হয়েছে। গত রোববার রাত ১১টায় তেজগাঁওয়ের বিটাক মোড়ে সংঘর্ষে জড়ান বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটি (বুটেক্স) ও ঢাকা পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। চা খাওয়ার সময় কথা–কাটাকাটির এক পর্যায়ে সংঘর্ষ বাধে। প্রায় ৩০ জন আহত হন।
কয়েক দিন ধরে ঢাকা শহরে বিভিন্ন জায়গায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা এবং কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে গতকাল ফেসবুকে এক পোস্টে সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম লিখেছেন, ‘...একটি দল এবং দেশি-বিদেশি সুযোগসন্ধানী এস্টাবলিশমেন্ট গত তিন মাসে ছাত্রদের ভিলিফাই (সম্মানহানি) করেছে, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন দিয়ে ছাত্রদের মধ্যে বিভেদ ঘটিয়েছে, অন্য একটি তরুণ দলকে লেলিয়ে দিয়েছে ছাত্রদের বিরুদ্ধে, তদুপরি ছাত্রদের সাথে সম্মানজনকভাবে ডিল তো করেইনি, বরং ছাত্রদের তারা শত্রু গণ্য করেছে।’
ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধসংক্রান্ত হাইকোর্টের এক আদেশের পর এই রিকশাচালকেরা গত বৃহস্পতিবার থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করে আসছেন। সংঘর্ষ–ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। তবে গতকাল সকালের বিক্ষোভে সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। যদিও পরে হাইকোর্টের ওই আদেশের ওপর স্থিতাবস্থার আদেশ আসে।
এর মধ্যে গতকাল ভোরে শাহবাগে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক জড়ো করার খবরে উদ্বেগ ছড়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে। পরে জানা যায়, দুর্নীতিবিরোধী বিশেষ আইন প্রণয়নের দাবিতে সংহতি সমাবেশ করার কথা বলে সারা দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ আনার এই উদ্যোগ নিয়েছিল ‘অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন। অভিযোগ আছে, বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার কথা বলে এসব লোকজনকে ঢাকায় আনা হয়েছিল।
অপর দিকে একই দিন বেলা আড়াইটায় শাহবাগে জড়ো হয়ে প্রথম আলো কার্যালয় অভিমুখে যাত্রার ঘোষণা দিয়েছিল একটি পক্ষ। সব মিলিয়ে একধরনের সন্দেহ ও অস্থিরতা তৈরি হয়।
অবশ্য পুলিশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীর তৎপরতায় সেই কথিত সংহতি সমাবেশ আর হতে পারেনি। অন্যদিকে বিকেলে একদল লোক তেজগাঁও থানা এলাকায় জড়ো হয়ে প্রথম আলোর কার্যালয়ে সামনের রাস্তায় আসেন। তাঁরা প্রথম আলোর বিরুদ্ধে নানা স্লোগান ও বক্তৃতা দিয়ে চলে যান। তবে রাজশাহী ও বগুড়ায় প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
সারা দেশ থেকে শাহবাগে লোক জড়ো করার ঘটনার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য বা অন্য কোনো পক্ষের যোগসূত্র আছে কি না, সে সন্দেহ সরকারের মধ্যেও তৈরি হয়। সন্ধ্যায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, গতকাল অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে দেখা গেছে ভোররাত থেকে ঢাকায় বাস, মাইক্রোবাসে করে কিছু সাধারণ মানুষকে নিয়ে আসা হয়েছে ঋণ দেওয়ার নাম করে। অহিংস গণ–অভ্যুত্থান নামে একটি প্ল্যাটফর্ম পুরো মিথ্যা প্রচারণা করে মানুষকে নিয়ে এসেছে। ওই প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ককে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে ‘দেশব্যাপী চলমান আন্তপ্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত’ নিয়ে জরুরি আলোচনা সভা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটি। সভা ডাকাসংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চলমান আন্তপ্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্ব–সংঘাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন উদ্বিঘ্ন। তারা মনে করে, ‘চলমান অন্তর্দ্বন্দ্ব ’২৪–এর গণ–অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রেরই অংশ’। নিবাহী কমিটির সভার পর রাতে তারা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গেও এ নিয়ে মতবিনিময় করে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সামগ্রিকভাবে ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে, অনেক ক্ষেত্রে সরকারের ব্যবস্থাপনার ঘাটতির বিষয়টিও আসবে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে উগ্র নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠী এবং পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তির ইন্ধন বা যোগসাজশে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা জরুরি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারকে আরও সক্রিয় ও উদ্যোগী হতে হবে।