ইতিহাস স্থির নয়। প্রতিমুহূর্তে এর নবরূপায়ণ ঘটে। ইতিহাসের কোনো সুনির্দিষ্ট ঘটনা বা কালপর্বের নানা ধরনের বয়ান থাকে। আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কোনো বয়ান প্রধান হয়ে ওঠে, কোনোটা প্রান্তিক। কালক্রমে নতুন তথ্য-তত্ত্ব-ব্যাখ্যা, মত-মতাদর্শে এসব বয়ান বিবর্তিত-পরিমার্জিত-পরিপুষ্ট হয় এবং বিবিধ শ্রেণি–পেশা, সম্প্রদায় কিংবা স্বার্থগোষ্ঠীর চিন্তা-যাপনের বিবিধ অনুষঙ্গ যুক্ত হয়ে ইতিহাসের এবং ফলত সমাজ-রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপায়ণ ঘটায়।
গণতান্ত্রিক সমাজের প্রধান লক্ষণই হলো মতাদর্শিক বহুত্ব, সমাজ-রাষ্ট্র-ইতিহাসের নানা বয়ানের পারস্পরিক সহাবস্থান, জনপরিসরে সেগুলোর নিয়ত পর্যালোচনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় প্রতিনিয়ত তার সঞ্চারণের মাধ্যমে সমাজে বিবদমান বিভিন্ন স্বার্থপক্ষের মধ্যে ন্যূনতম সংহতি-সহাবস্থানের শর্ত তৈরি করা।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। কেন্দ্র থেকে প্রান্তজুড়ে বিচিত্র শ্রেণি-পেশা-বর্গের অংশগ্রহণে একটি জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাতাড়িত রক্তক্ষয়ী এই জনযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু নতুন রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে একরৈখিক-একাধিপত্যশীল এক মহাবয়ানে সীমিত করে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মতাদর্শিক হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। তাদের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘জাতীয়তাবাদ’-এর আদর্শ অন্তর্নিহিতভাবেই ছিল অপরায়ণে উন্মুখ ও বর্জনকামী।
জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশকে মুক্তিযুদ্ধ ও তার আকাঙ্ক্ষাজাত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া থেকে চিরস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এর চরম কর্তৃত্ববাদী মতাদর্শগত একত্ববাদ হলো এক জাতি, এক ভাষা, এক দল, এক নেতা, এক ইতিহাস। পরবর্তী পাঁচ দশকের বাংলাদেশের ইতিহাস নানা বাঁকবদল পেরিয়ে এই কর্তৃত্ববাদী কাঠামোরই জয়জয়কার। আর তার মধ্যস্থতায় জাতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন প্রান্তিক, জনশ্রমঘনিষ্ঠ, রূপান্তরকামী বয়ানগুলোকে পিষ্ট করা এবং তার মাধ্যমে সমাজের পুনরুজ্জীবনী শক্তিকে চূড়ান্তভাবে নিঃশেষিত করা।
এর ঈষৎ ছেদ ঘটেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্য কিছু প্রতিরূপের উত্থানে—‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ বা ‘ইসলামি রাষ্ট্র/জাতীয়তাবাদ’ আকারে। তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের দীর্ঘ ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভিত্তিমূলের কারণে এসব আলটপকা মতাদর্শিক বয়ান শক্ত লড়াই তৈরি করতে পারেনি।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিভূমি তৈরি হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসনে প্রযোজিত উনিশ শতকের ‘বাংলার নবজাগরণ’-এর মাধ্যমে। এর প্রধান অগ্রগামী বাহিনী ছিল ইংরেজভক্ত ও মুসলমান-বিদ্বিষ্ট নবগঠিত হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণি। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অমোচনীয় বিচ্ছিন্নতা এবং মুসলমান সমাজের অপরায়ণ। এ কারণে কৃষিপ্রধান পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের কাছে পাকিস্তান আন্দোলন হাজির হয়েছিল প্রধানত সামাজিক-রাজনৈতিক এই অপরায়ণের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোতে নিষ্পেষিত নিম্নবর্গের মানুষের শোষণমুক্তির আন্দোলনের তাৎপর্য নিয়ে। এই নিম্নবর্গে একাত্ম হয়েছিলেন বিপুলাকার তফসিলি হিন্দুরাও।
কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা কোনো গণ-আন্দোলনের ক্লাইম্যাক্স আকারে আসেনি। আদতে তা ছিল ব্রিটেনের সংসদ কর্তৃক তার পূর্বতন উপনিবেশ থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার আনুষ্ঠানিক–আইনি উদ্যোগ। সেটি ছিল ১৯৪০-এর দশকজুড়ে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত কৃষক বিদ্রোহকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে চালিত করে অধিপতিশীল অভিজাত শ্রেণির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া। সে কারণে আইনি ও সাংবিধানিক বিধিবিধানে শোষণ-নিপীড়নের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রে ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ববাদী কাঠামো অটুট থাকে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে পাকিস্তানে প্রথমে প্রতিষ্ঠিত হয় একধরনের ছদ্ম-গণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী শাসন, পরে সামরিক কর্তৃত্ববাদ। আমলাতান্ত্রিক ঐতিহ্য, সামরিক বাহিনীর ক্রমবর্ধমান প্রভাব, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান, পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক-স্বার্থ ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভূস্বামী (ও মোহাজের)-স্বার্থের অমোচনীয় দ্বন্দ্ব এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতির কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তার প্রতিক্রিয়ায় পূর্ববঙ্গের স্বাধিকার আন্দোলনে ‘বাঙালি’ পরিচয়বাদী প্রধান-প্রবণতার বাইরেও নয়া ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার বিপরীতে ‘কৃষক শ্রমিক স্বরাজ’ কিংবা ‘জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনের’ আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হতে দেখা যায়। বিবিধ রাজনৈতিক-মতাদর্শিক পক্ষের অংশগ্রহণে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ায় তার একটি ঐতিহাসিক সুযোগও তৈরি হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর প্রধান রাজনৈতিক দলের শ্রেণিচরিত্র এবং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অভিজাতদের মননে ঔপনিবেশিক বাংলার বর্ণবাদী-জাতিবাদী সংস্কৃতির আধিপত্যের কারণে সেই সুযোগ বিনষ্ট হয়।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধের নয়টি কারণ বা হেতুর উল্লেখ আছে। তার সারমর্ম এ রকম: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছিল ‘শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে’। কিন্তু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ অধিবেশন স্থগিত করে আলাপ-আলোচনা চলাকালে ‘ন্যায়নীতিবহির্ভূত ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ’ চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ‘বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে একত্র হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব’ করে তুলেছিল। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণ ছিল সংবিধান প্রণয়ন করতে না দেওয়া এবং নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র’ হিসেবে গঠন করা।
অথচ রাষ্ট্রগঠনের শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের এই প্রতিশ্রুতি বর্জিত হয় এবং রাষ্ট্র গঠন–প্রক্রিয়া থেকে জনগণকে বের করে দেওয়া হয়। সংবিধান প্রণয়ন–প্রক্রিয়া থেকে আওয়ামী লীগ ছাড়া প্রায় সব দলকে বাদ দেওয়া হয়। মাওলানা ভাসানীর ন্যাপসহ অনেক রাজনৈতিক দল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সর্বদলীয় জাতীয় সরকারের দাবি উঠলেও তা নাকচ করা হয়। নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ গঠন না করে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী পাকিস্তানে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য গঠিত গণপরিষদ (এমনকি প্রাদেশিক পরিষদের) সদস্যদের নিয়ে স্বাধীন দেশের গণপরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদের দুজন বাদে বাকি সবাই ছিলেন একদলভুক্ত। এর ফলে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে উঠে আসে সংকীর্ণ জাতিবাদী-সেক্যুলারিস্ট মতাদর্শ। এর ফলে রাষ্ট্র সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে সম্বোধনের কোনো কার্যকর উপায় বের করতে পারে না। রাষ্ট্র তাকে ক্রমাগতভাবে ‘অপর’ করে তোলে, তার কর্তাসত্তা পর্যুদস্ত করে রাষ্ট্র গঠন–প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। রাষ্ট্র হয়ে ওঠে গুটি কয়েকের হাতে ক্ষমতার পালাবদলের খোলা ময়দান। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘মুক্তচিন্তা’, কখনো বা ‘প্রগতিশীলতা’র নামে এক মতাদর্শ জনপরিসরে রাজত্ব করতে থাকে। ভিন্নমতের দমন অনায়াস বৈধতা ও স্বাভাবিকতা পায় এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণের প্রক্রিয়া অসম্ভব করে তোলে। রাষ্ট্র পতিত হয় চরম কর্তৃত্ববাদের কবলে।
শিক্ষা-সংস্কৃতি-গণমাধ্যমসহ নানা মতাদর্শিক অস্ত্র তার পক্ষে ক্রমাগত সম্মতি উৎপাদনে ব্যস্ত থাকে।
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানকেও যে সংকীর্ণ কোটাবিরোধী আন্দোলন আকারে পাঠ করা হচ্ছে, তা-ও ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী প্রধান স্বার্থগোষ্ঠীগুলোর ওপর পুরোনো মতাদর্শিক একাধিপত্যের ফল। আমরা অন্তত গত এক দশকে, বিশেষত নগর-মধ্যবিত্ত চিন্তা পরিসরে মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ও রাজনীতির এই একরৈখিক বয়ানের বিপরীতে নতুন চিন্তার উৎসারণ এবং বহুত্ববাদী রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ দেখতে পাচ্ছি না। প্রতাপশালী কর্তৃত্ববাদী শাসন ও তার মতাদর্শিক সম্মতি উৎপাদনকারী সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পক্ষগুলোর তৎপরতার কারণে তা ‘চোরাস্রোত’ হিসেবে রয়ে গেছে।
তবে প্রযুক্তির কল্যাণে অনলাইন-অফলাইনে বিপুলাকার সভা-সমিতি, পাঠচক্র, বক্তৃতা এবং কিছুটা লেখালেখির মাধ্যমে প্রান্তিক নানা ডিসকোর্স, ইতিহাসের নানা ব্যতিক্রমী বয়ান নতুন মধ্যবিত্ত, বিশেষত ছাত্র-তরুণ সমাজের মনোজগতে বিপুল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। জুলাই অভ্যুত্থানে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্পৃক্ততার কারণ এই রাজনৈতিক-মতাদর্শিক রূপান্তরজনিত নতুন এক সর্বজনীন ভাষা; একাধিপত্যের কৌশলপ্রসূত মতাদর্শিক বিভাজন পেরিয়ে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে নতুন জন–আকাঙ্ক্ষার স্ফুরণ। এই জন–আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হতে পারে ব্যাপকতর জন–অংশগ্রহণের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।