চট্টগ্রামের ব্রতের ভাত ও আরোগ্য কামনার আশ্বিন–কার্তিক

ব্রতের ভাত:প্রতীকী ছবি

বর্ষার পানি নেমে গেছে গ্রাম থেকে। শরৎ শেষ হয়ে হেমন্তে প্রবেশ করছে ঋতুচক্র। ভোরের ফসলের মাঠে এখন চোখে পড়বে হালকা কুয়াশার চাদর। গ্রামবাংলায় এই সময় ফসলের খেতে পোকামাকড়ের আক্রমণ বাড়ে। ঘরে ঘরে দেখা দেয় সংক্রামক রোগ বা মহামারি। ঋতু পরিবর্তনের এ সময় ঘিরে আরোগ্য কামনায় কৃষিপ্রধান গ্রামাঞ্চলে নানান ব্রত, আচার ও প্রথা গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রামের ব্রতের ভাতও এমনই এক প্রথা।

চট্টগ্রামে এই রীতি আশ্বিনকুমারীর ব্রত নামে পরিচিত। ঋগ্‌বেদে সূর্যদেব ও সংজ্ঞা দেবীর যমজ ছেলে অশ্বিনীকুমার ভাইদের চিকিৎসক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মহাভারতের আদিপর্বে দেব-চিকিৎসক হিসেবে তাদের উল্লেখ রয়েছে। চিকিৎসাবিষয়ক তাদের রচিত গ্রন্থের নাম ‘চিকিৎসা-সার-তত্ত্ব’। আকন্দগাছের পাতা খেয়ে অন্ধ হয়ে যাওয়া উপমন্যুর চোখ ভালো করে দেন তারা। আবার ভোজরাজকে অজ্ঞান করে তার মাথার খুলিতে ঢুকে যাওয়া মাছও বের করে আনেন। কার্তিক মাসে সকালবেলা কলা, নারকেল আর গুড় মেশানো ভাত খেয়ে পৌরাণিক এই চিকিৎসকদের স্মরণে ব্রত পালন করা হয়। চট্টগ্রামের মানুষের মুখে এই অশ্বিনীকুমার হয়ে গেছে আশ্বিনকুমারী ব্রত। পানিভাত বা পান্তাভাতের ব্রত নামেও একে ডাকা হয় চট্টগ্রামে। এক রাতের বাসি এই পান্তাভাতকে ঔষধি বলে গণ্য করা হয়।

আশ্বিন ও কার্তিকের গাড়ুসংক্রান্তি, নলসংক্রান্তি, অশ্বিনীকুমার ব্রত, ডাকসংক্রান্তি, দীপদান, প্রবারণা, ভাইফোঁটা, কুল-কুলতি ব্রত, যমপুকুর ব্রত—সবই কোথাও না কোথাও আরোগ্য কামনার সঙ্গে জুড়ে আছে। ব্রতাচার বা ধর্মীয় এসব আচার অনুষ্ঠানকে একটু তলিয়ে দেখলে কমিউনিটি মেডিসিন বা সামাজিক নিরাময়চর্চার আদি ইতিহাস পাওয়া যায়। লোকজ ছড়ার মধ্যেও এসবের দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে।

আশ্বিনে রাঁধে কার্তিকে খায়

যে বর মাগে সেই বর পায়।

এই সময়ে চট্টগ্রামের মতো সিলেট আর ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পালিত হয় গাড়ুসংক্রান্তি বা গাসসি ব্রত। ব্রতের অংশ হিসেবে আশ্বিনের শেষ দিন রাঁধা বাসি ভাত-তরকারি কার্তিকের প্রথম দিন খেতে হয়। শেষ দিন গ্রাম ঘুরে কাঁচা হলুদ, গিলা, মেথি, নিম, নিশিন্দা, কালমেঘ, পেয়ারা ও বরইয়ের কুঁড়ি কুড়িয়ে আনে বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা। সাধারণত গ্রামের মোড়ল বা বড় উঠানওয়ালা কোনো বাড়িতে এই আচার পালিত হয়। সারা রাত জেগে গান, বাজনা, লাঠিখেলা আর এসব মিশ্রণ তৈরির কাজ চলে। ভোরবেলা সেই মিশ্রণ মেখে সবাই মিলে পুকুর বা নদীতে গোসল করতে যান। এর নাম গাড়ুর গোসল। সেখান থেকে ফিরে করলা বা নিমপাতা খেতে হয় সবাইকে। এরপর সেই বাসি ভাত-তরকারি বা গাড়ুর ভাত খাওয়া হয়। এই দিন বিশেষ ধরনের ডালও রান্না করা হয়, যার নাম গাড়ুর ডাল। মটর বা খেসারিজাতীয় ডালে নানান সেদ্ধ সবজি, যেমন কুমড়া, গাঠি কচু, দুধ কচু, মান কচু ইত্যাদি মিশিয়ে রান্না করা হয়। এই রান্নায় তেল ব্যবহার করা হয় না। গাড়ুসংক্রান্তির পাশাপাশি এই সময় খেতের ফসলের রোগবালাই দূর করার জন্য পালিত হয় নলসংক্রান্তি। নলসংক্রান্তির ছড়ায় পোকা দমনের কৌশলও বলা আছে।

অন সরিষা কাঁকুড় নাড়ি

যা রে পোক ধানকে ছাড়ি

এতে আছে হলদি/ ধান ফলবে জলদি

এতে আছে নীল আদা/ ধান হবে গাদা গাদা

এতে আছে নিম/ পোকার মাথা ঝিমঝিম

নলসংক্রান্তিতে হলুদ, ওল, নিম, কালমেঘ, তুলসী, আদা, ভেট, বহেরা, নটে খাড়া—আদারে-বাদাড়ে যত রকমের তিতকুটে আর তীব্র গন্ধযুক্ত ভেষজ আছে, সব তুলে আনা হয়। সঙ্গে আনা হয় নলখাগড়ার গাছ। রাত জেগে সব গাছগাছড়া বেটে তৈরি হয় আলাই। তাতে মেশানো হয় আতপ চাল আর কুচো চিংড়ি। বড় একটা পাতায় আলাই নিয়ে নতুন পাট দিয়ে বাঁধা হয় নলগাছের সঙ্গে। এর নাম নল বাঁধা বা বরোজ বাঁধা। বাঁধা বরোজ সারা রাত ফেলে রাখা হয় শিশিরে। কাকডাকা ভোরে বরোজ বাঁধা নলগাছ, বেলপাতা, শালুক, সিঁদুর ভেট দিয়ে ধানের ভালো ফলনের প্রার্থনা করা হয়। জমির ঈশান কোণে গোড়ায় তালশাঁস দিয়ে নলগাছটি পুঁতে, পানি ছিটিয়ে ঘরে ফেরেন কৃষক। পুকুরপাড়ে, ঘরের ছাদে, তুলসীতলায়ও বরোজ বাঁধা নলগাছ পুঁততে হয়। নলগাছে এসে বসে লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচা। পুঁটুলিতে চিংড়ি বা চালের গুঁড়োর লোভে পাখিরাও এসে বসে। এরপর খুঁটে খুঁটে জমির ইঁদুর, পোকা খায়। নলগাছ বহু প্রজনন শক্তির অধিকারী। কামনা করা হয় নলখাগড়ার মতো উর্বর ও লাবণ্যময় হয়ে উঠুক ধানের শরীর। এ জন্যই বলা হয়—

ফাটলে দিয়ে নল/ ধান ফলে গল-গল

নল পড়ল ভুঁয়ে/ যা শনি তুই উত্তর মুয়ে।

শনি মানে কীটপতঙ্গ, রোগবালাই। আশ্বিনের মাঝামাঝি থেকে কার্তিকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমন ধানের গর্ভকাল। ধানগাছের মিষ্টি দুধ এ সময় পোকামাকড়কে আকর্ষণ করে। তবে তীব্র কটু গন্ধ আর তেতো স্বাদ পোকাদের খুব অপছন্দ, সেটা বুঝেছিলেন আমাদের কিষানিরা। দুই বাংলা, আসাম, ওডিশার ঘরে ঘরে পালিত হয় নলসংক্রান্তি। পুরুলিয়াতে বলে জিহুড়। নলসংক্রান্তির পর টানা এক মাস আকাশপ্রদীপ জ্বালানো হয় রোজ সন্ধ্যাবেলা। মুসলমান কৃষকেরা জমিতে নল পোঁতার সময় ছড়া কাটেন—

হিন্দুয়াকা যোহি বোল/ হামরা ভি ওহি বোল।

ধান ফো ও ল/ধান ফো ও ল।

উত্তর দিনাজপুরের মুসলিমরা এই প্রথাকে বলে গাড়িগুড়ি। মাটির হাঁড়িতে খৈল, লেবুপাতা, নিমপাতা জলে মিশিয়ে জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। গোলাঘরের দরজায় মুরগি জবাই দেওয়া হয় এদিন। কালো ধোনিয়া চালের ভাত, মুরগি আর কচুর তরকারি কলাপাতায় রেখে খাওয়ার চল। সন্ধ্যা হলে ভোগা বা প্রদীপের আলোয় সারা মাঠ আলোকিত হয়ে ওঠে। জমিতে প্রদীপ জ্বেলে বলা হয়—

গাড়ি গুড়ি কচুর ফুতি

আয় মা লক্ষ্মী হামার ভিতি।

এই সময় আরও কয়েক ধরনের ব্রত পালিত হয়। এসবের মধ্যে ধান, মানকচু, কলা, হলুদ, কলমি, শুষনি, হিঞ্চেগাছ, সুপারি, কড়ি এবং মাটির মূর্তি দিয়ে পালিত হয় যমপুকুর ব্রত। আর কুল-কুলতি ব্রত মূলত তুলসীগাছের ও বরইপাতার ভেষজ গুণের প্রতি নারীদের নিবেদন।

নারীদের যেমন ব্রত রয়েছে, তেমনি পুরুষদের জন্য রয়েছে ডাকসংক্রান্তি। ডাক শব্দের আদি অর্থ জ্ঞান। এ নিয়ে প্রচলিত লোককথাটি হলো আশ্বিন শেষের আগের রাতে লাঠি ও জ্বলন্ত মশাল হাতে গ্রামবাসীকে জড়ো করতেন এক জ্ঞানী বা ডাকপুরুষ। খোলামাঠে সবাইকে নিয়ে গিয়ে শারীরিক কসরত ও মন্ত্রৌষধির শিক্ষা দিতেন। তাই আজও সংক্রান্তিতে কুস্তি, লাঠিখেলা, মশাল জ্বালানো, আগুন পোহানোর আয়োজন করেন গ্রামের যুবকেরা। রাত শেষে নদীতে ডুব দিয়ে ‘ডাক জল’ নিয়ে বাড়িতে আসেন। বাড়ির সবাই নিমপাতা ও তালশাঁস খেয়ে ওই জল পান করেন। এটাই ডাকপুরুষের আদেশ। রামেশ্বর ভট্টাচার্যের শিবায়ন কাব্যে চাষি শিবও ডাকসংক্রান্তিতে তাঁর চাষের খেতে নল পুঁতেছিলেন। শত শত বছর ধরে চর্চিত এসব জ্ঞান আমাদের পূর্বজদেরই আবিষ্কার। মশাল জ্বেলে এ সময় গ্রামের কৃষকেরা শব্দ করে ঘুরে বেড়ান পাড়ায় পাড়ায়। দীপ, মশাল বা ফানুস জ্বালানো মূলত পোকামাকড় বা ইঁদুর দুরে রাখার রীতি।