জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানের চেয়ে সরকার এখনো জোর দিচ্ছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়ানোর দিকে। এলএনজি আমদানির জন্য নতুন নতুন অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে বুধবার সিপিডি আয়োজিত এক সেমিনারে সংস্থাটির পক্ষ থেকে এসব কথা বলা হয়। এতে ‘বাংলাদেশের জ্বালানি রূপান্তর নিয়ে নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিভঙ্গি’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করা হয়।
সিপিডির নিবন্ধ বলছে, ২০২৩ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতার ৪১ শতাংশ অলস ছিল। চাহিদার চেয়ে সক্ষমতা বেশি থাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হচ্ছে সরকারকে। তাই বিদ্যুতের চাহিদার প্রক্ষেপণ পুনরায় মূল্যায়ন করা উচিত, যাতে নতুন করে আর অতিরিক্ত সক্ষমতা না বেড়ে যায়। একই সঙ্গে কয়লা থেকে সরে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে জোর দিতে হবে। আর জ্বালানির দাম নির্ধারণে যেন ভোক্তার ওপর চাপ না পড়ে।
সিপিডির নিবন্ধে বলা হয়, জ্বালানি তেল ও এলএনজির বিল দিতে ডলার জোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছে বিপিসি ও পেট্রোবাংলা। তাদের ৭০ কোটি ডলার বকেয়া জমেছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আমদানির জন্য ডলারের চাহিদা আরও বাড়ছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য তানভীর শাকিল বলেন, ২০০৮ সালে মানুষ বিদ্যুৎ-সংযোগের দাবি জানাত। এখন আর কেউ এটা জানায় না। শতভাগ বিদ্যুতায়ন সরকারের বড় সাফল্য। মানুষ বিদ্যুৎ পেতে চায়, উৎস জানতে চায় না। এখন অনেকেই রেন্টাল (ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র) নিয়ে সমালোচনা করে; ওই সময় দ্রুত বিদ্যুৎ পৌঁছাতেই সরকার এটা বেছে নিয়েছিল। জ্বালানি এখন মানুষের মৌলিক চাহিদার মতো হয়ে গেছে। জনগণের চাহিদা বুঝেই সরকার কাজ করে।
জ্বালানি একটি কৌশলগত খাত। এর প্রভাব সব খাতে পড়ে। তাই এ খাতকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় রাখতে হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি-গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে সব বিস্তারিত থাকে না, নীতির বিষয়ে অঙ্গীকার থাকে। আর সরকার সবই করছে। দরপত্র না থাকলেও সর্বোচ্চ সমঝোতার মাধ্যমেই চুক্তি করা হয়। বিশেষজ্ঞরা যাঁর যাঁর খাত নিয়ে জোর দেন, অন্য খাতেরটা দেখেন না। কিন্তু সরকারকে সব দিক সমন্বয় করে পরিকল্পনা নিতে হয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ম তামিম বলেন, এখন যে পরিমাণ কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, তা চালানোর পর সর্বোচ্চ তিন হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ নেওয়া যাবে। এর বেশি সৌরবিদ্যুৎ করা হলে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দিতে হবে। ভারত ও চীন বিশ্বের সর্বোচ্চ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী, আবার তারা সর্বোচ্চ কয়লাবিদ্যুৎ ব্যবহার করে। তাই খুবই সতর্কতার সঙ্গে পরিকল্পনা করে এগোতে হবে।
ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম বলেন, এটা গ্যাসের দেশ। এখানে জ্বালানির কোনো সমস্যাই হতে পারে না। সমস্যা হচ্ছে অনুসন্ধান না করা। যথাযথ অনুসন্ধান করে গ্যাস উৎপাদন করলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোনো সমস্যাই থাকে না।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক শফিকুল ইসলাম, ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) বিশ্লেষক শফিকুল আলম প্রমুখ।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতার কারণে ডলার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ইতিহাসের সর্বোচ্চ লোকসানের দায়ে পড়েছে পিডিবি। জ্বালানি খাতে স্বয়ংক্রিয় দাম নির্ধারণের দিকে যাচ্ছে সরকার। এতে যেন ভোক্তার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখে দাম নির্ধারণের সূত্র তৈরি করতে হবে।
সেমিনার সঞ্চালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, জ্বালানি একটি কৌশলগত খাত। এর প্রভাব সব খাতে পড়ে। তাই এ খাতকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় রাখতে হয়। ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যাচ্ছে বাংলাদেশ। তাই নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দিতেই হবে।
অনুষ্ঠানে নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। গত চারটি (২০০৮, ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪) জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জ্বালানি খাত নিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির অঙ্গীকার তুলনামূলক পর্যালোচনা করেন তিনি।