স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে স্বাচিপ সমর্থিত কর্মকর্তারা যাননি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ফাইল ছবি

রাজধানীর সরকারি মেডিকেল কলেজ, বড় হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন কয়েকটি দপ্তর কার্যত নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) সমর্থিত কর্মকর্তা ও চিকিৎসকেরা অফিসে না আসায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ১০টি প্রতিষ্ঠান ঘুরে শীর্ষ পদে থাকা অধিকাংশ কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি, তাঁরা কর্মক্ষেত্রে আসেননি। প্রতিষ্ঠানগুলোতে থমথমে পরিবেশ লক্ষ করা গেছে। পাশাপাশি ভাঙচুরের দৃশ্যও চোখে পড়েছে।

সকাল সাড়ে ১০টায় শাহবাগ এলাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক নম্বর ফটক দিয়ে ঢুকে দেখা যায়, বটতলায় বিএনপি-সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সভা চলছে। বি ব্লকে দোতলায় উঠে দেখা যায়, উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের ফটক বন্ধ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসএমএমইউর উপাচার্যের কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, রেজিস্ট্রার, প্রায় ৩০টি বিভাগের চেয়ারম্যান, অধ্যাপকদের বড় অংশ সবাই স্বাচিবের সদস্য। তাঁরা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেননি। আসতে ভয় পাচ্ছেন। অন্যদিকে ড্যাবের সদস্য চিকিৎসকেরা আনন্দমিছিল আর সভা করছেন। চিকিৎসা পাওয়া দূরে থাক, রোগীরা আছেন আতঙ্কে।

বেলা সোয়া ১১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে জানা যায়, কলেজের অধ্যক্ষ দুই দিন ধরে আসছেন না। অধ্যক্ষের কার্যালয়ের সামনে বসে থাকা কর্মচারীরা বললেন, পরিস্থিতি ভালো নয়, তাই অধ্যক্ষ আসেননি। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতাল ঠিকমতো চলছে।

দুপুর সাড়ে ১২টায় শেরেবাংলা নগর এলাকায় জাতীয় অর্থোপেডিক ইনস্টিটিউট ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল বলে পরিচিত) গিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের পরিচালকসহ বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক অনুপস্থিত। প্রতিষ্ঠানের সকালের নিয়মিত পর্যালোচনা সভা হয়নি। নির্ধারিত নিয়মিত অস্ত্রোপচারও হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অধ্যাপক বলেন, প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি শীর্ষ পদে আওয়ামীপন্থী চিকিৎসকেরা। পদ দখলের পাশাপাশি তাঁরা প্রতিষ্ঠানের নিয়মনীতি ও কার্যপদ্ধতিও নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। এতে ড্যাব-সমর্থক চিকিৎসকদের মধ্যে ক্ষোভ জমে আছে। ড্যাবের ভয়ে স্বাচিব এখন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় উধাও।

একই এলাকায় জাতীয় নিউরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক কাজী দীন মোহাম্মদ, যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক বদরুল আলমসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও চিকিৎসকেরা উপস্থিত ছিলেন। ২৫০ শয্যার যক্ষ্মা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালে রোগীর ভিড় কম। এই হাসপাতালের পরিচালকের পদ খালি। উপপরিচালক আয়েশা আক্তার বলেন, হাসপাতাল স্বাভাবিক আছে।

বেলা একটার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের কক্ষে তালা দেখা যায়। কলেজের অধ্যক্ষের দপ্তরও বন্ধ ছিল। একজন কর্মচারী বলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হাসপাতালে আসেন।’

বেলা দুইটার দিকে মহাখালীতে শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড থেকে ‘শেখ রাসেল’ শব্দ দুটি মুছে ফেলা হয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক হাসপাতালে আসেননি। একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, হাসপাতাল থেকে রোগীদের অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দিয়ে দেখা যায়, মহাপরিচালক, দুই অতিরিক্ত মহাপরিচালকসহ সব শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার কক্ষে তালা। একজন কর্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (শিক্ষা) গতকাল কিছু সময়ের জন্য অধিদপ্তরে এসেছিলেন।

ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস), জাতীয় পুষ্টি প্রতিষ্ঠান এবং নিপসম পরপর তিনটি প্রতিষ্ঠান। এর কোনোটির পরিচালক বা শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের দপ্তরে গিয়ে পাওয়া যায়নি।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরের শীর্ষ পদগুলোতে স্বাচিবের সদস্য বা সমর্থকদের পদায়ন করা হয়। অভিযোগ আছে, যোগ্যতা থাকলেও ড্যাবের সদস্য বা নিরপেক্ষ চিকিৎসকেরা এসব পদ পাননি। ১৫ বছরে তাঁরা নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছেন। অনেকে ক্ষুব্ধ। তাঁদের ভয়ে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীপন্থী চিকিৎসকেরা এসব প্রতিষ্ঠানে আসছেন না।

চিকিৎসকদের দলীয় রাজনীতির বাইরে থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসকদের দলীয় রাজনীতির কারণে অনেক অযোগ্য লোককে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হচ্ছে বা পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। এতে দাপ্তরিক কাজ যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি মানুষ নানাভাবে সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন। এটা বহু বছর ধরে চলছে। এখন সময় এসেছে চিকিৎসকদের দলীয় রাজনীতি থেকে বাইরে আসার।