২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

প্রতি ৩ শিশুর একজনের খেলার সময় নেই

নারকেলগাছের পাতা দিয়ে হাতঘড়ি–চশমা বানানো, গাছের ফুল–পাতা ছিঁড়ে ছোট্ট হাঁড়িতে রান্নাবাটি—এই খেলাগুলোর কথা মনে পড়লে হুড়মুড় করে স্মৃতিরা সব ভিড় করে। সেই সঙ্গে শিশুবেলার খেলার সাথীদের মুখ ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। যারা হয়তো সঙ্গী না হলে পুঁইফলের রং দিয়ে আঁকিবুঁকি, আর খেজুরগাছের পাতার চরকি নিয়ে দৌড়ানোর আনন্দ পূর্ণতা পেত না। আর গোল্লাছুট, কুতকুত, দাঁড়িয়াবান্ধা, কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলাগুলো সম্ভবই হতো না।
সন্তানেরা এখন কতটা খেলে সেটা বলতে গিয়ে কয়েকজন অভিভাবকের মুখে এমন স্মৃতিচারণা উঠে এল। সেই সঙ্গে তাঁদের কণ্ঠে আফসোস। কারণ, নিজেদের সন্তানেরা এখন এমন খেলায় মাতার সুযোগ পায় না। সঙ্গী বা খেলার জন্য খোলা জায়গা পায় না। এসব খেলার অনেকগুলো এখনকার শিশুরা চেনেও না। তা ছাড়া তাঁরা নিজেরাও ‘আগে পড়া, তারপর অন্যকিছু’ এই চাপে রাখেন শিশুদের। ফলে পড়ালেখার চাপের মধ্যে খেলার গুরুত্ব হারিয়ে যায়। অন্যদিকে শ্রমজীবী শিশুদেরও এভাবে শৈশব ছেঁটে ফেলা হচ্ছে ছোট্ট কাঁধে সংসারের দায় চাপিয়ে।

খোলা জায়গা পাওয়া না গেলে অন্তত ঘরের ভেতর যেকোনো জিনিস দিয়ে, ছড়া গান, গল্প বলা ইত্যাদির মাধ্যমেও যেন শিশুদের খেলার সময় ও সুযোগ দেওয়া হয়, সে জন্য মা–বাবাকে সচেতন হতে হবে। শুধু মুঠোফোনে খেললে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা হয় না।
ইরাম মরিয়ম, নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট এডুকেশন

দ্য ইন্টারন্যাশনাল ডে অব প্লে (আইডপ) গ্লোবাল নেটওয়ার্কের  ‘দ্য পাওয়ার অব প্লে’ (খেলার শক্তি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি তিনজনের একজন শিশু খেলার জন্য যথেষ্ট সময় পায় না। প্রতি পাঁচজনের একজনের খেলার নিরাপদ জায়গা নেই। প্রতিবন্ধী শিশুদের ক্ষেত্রে প্রতি তিনজনের একজনের খেলার সঙ্গী নেই। বাংলাদেশের ৪০০ শিশুসহ বিশ্বের ২১টি দেশের ৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী ১০ হাজারের বেশি শিশুর মতামতের ভিত্তিতে জরিপ প্রতিবেদনটি এ বছর প্রকাশ করা হয়েছে।
শিশুদের জীবনে খেলাধুলার গুরুত্ব বাড়ানোর মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ ও মেধা বিকাশের প্রতি জোর দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আজ ১১ জুন প্রথমবারের মতো পালিত হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ডে অব প্লে বা আন্তর্জাতিক খেলা দিবস। এ বছরের ২৫ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৪০টিরও বেশি দেশের সম্মতিতে নতুন এই দিবস ঘোষণার প্রস্তাব গৃহীত হয়। দিবসটি পালনে আইডপ নেটওয়ার্কের সমন্বয় করছে দ্য লেগো ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশ থেকে ব্র্যাক এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে রয়েছে। বাংলাদেশ, উগান্ডা, তানজানিয়া ও সিয়েরালিওন—এই চারটি দেশের শিশু, অভিভাবক ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর গবেষণা পরিচালনা করেছে ব্র্যাক।

শৈশব যখন কাটছাঁটে

ব্যাংক কর্মকর্তা দম্পতি আফরিনা খানম ও ফজলুল করিম খানের দুই সন্তান। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা তাঁরা। কন্যা আলিশা আফরিন খান (১১) এবং পুত্র আরিশ আফরাজ খান (৯) ভিন্ন স্কুলে কন্যা দিবা শাখা ও পুত্র প্রভাতি শাখায় পড়ে। মা আফরিনা খানম প্রথম আলোকে বলেন, টিউশন, হোমওয়ার্ক, ড্রয়িং ক্লাস, স্কুলের আইকিউ ক্লাবের ক্লাসের ফাঁকে অবসর পাওয়াই একটি বড় বিষয়। যতটুকু সময় পায় পুত্র–কন্যা মুঠোফোনে থাকতে পছন্দ করে। তাঁরা বাড়ি ফিরে রাতে সন্তানদের সঙ্গে কিছুটা খেলেন। কিন্তু সন্তানেরা খোলা জায়গায় সঙ্গীদের সঙ্গে খেলতে চায়। খোলা জায়গা না থাকা ও নিরপত্তাহীনতার কারণে তিনি সন্তানদের সেই সুযোগ দিতে পারেন না।
কোনো কোনো অভিভাবকের মতে, খেলাধুলার সুযোগ না পেতে পেতে গেজেটে খেলার চক্রে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে শিশুরা। ফলে গ্রামে মাঠ থাকার পরও অনেক শিশু-কিশোরেরা মুঠোফোনে বুঁদ হয়ে থাকে।

দেশীয় জিনিস দিয়ে খেলতে দিলে শিশুরা বেশি একাত্মবোধ করে। মা–বাবারাও নিজেদের শৈশবে ফিরে যান ও শিশুদের সঙ্গে খেলতে উৎসাহ বোধ করেন। শিশুদের শিক্ষা ও খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি খেলাধুলা তাদের জীবনে যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে, তা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

মিজানুর রহমান নামের এক অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর তিন সন্তানের মধ্যে ছোট দুটি শিশু। ১৩ ও ১০ বছর বয়সী মেয়ে ও ছেলেকে স্কুলের মাঠে ছুটির দিনে খেলার জন্য ভর্তি করেছিলেন। তবে খেলার ফি ১ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১৫ হাজার টাকা হওয়ায় সেটা বন্ধ করে দিয়েছেন। বাসায় লুডু, দাবা, রুবিকস কিউব কিনে দিয়েছেন। কিন্তু এ খেলাগুলো ছেলে–মেয়েদের কাছে খুব সাদামাটা লাগে। এর চেয়ে তারা মুঠোফোন, ট্যাব, কম্পিউটারে ভার্চ্যুয়াল খেলায় অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে ও আনন্দ পায়। পড়ালেখার পর যতটুকু ফুরসত পায়, তারা গেজেটেই ডুবে থাকে।
আইডপের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারও খেলার সময় নেই। কারও খেলার অনুমতি নেই। কারও খেলাধুলা করার মতো অবকাঠামো নেই। এশিয়ার ২০ শতাংশ শিশুর খেলার অনুমতি নেই। আমেরিকা ও ইউরোপে এ হার ১০ শতাংশ এবং আফ্রিকায় ২৮ শতাংশ। শিশুদের খেলতে চাওয়ার আগ্রহ কতটা এবং শিশুমনে খেলার প্রভাব কতটা সেটাও উঠে এসেছে এই জরিপে। ৯৭ শতাংশ শিশু জানিয়েছে, খেলা তাদের জন্য জরুরি। ৭১ শতাংশ জানিয়েছে, খেলা তাদের আনন্দ দেয়। ৫৭ শতাংশ মনে করে, খেলার মাধ্যমে তাদের বন্ধু তৈরি হয়। ৪৫ শতাংশ জানিয়েছে, খেলার মাধ্যমে মা–বাবা ও পরিবারের সদস্য এবং যিনি তাদের যত্ন নেন (কেয়ারগিভার) তাঁদের সঙ্গে সময় কাটাতে তারা খেলতে ভালোবাসে।

‘খেলা ভালো’ এবং ‘খেলা শুধুই খেলা নয়, খেলতে খেলতে শেখা হয়’ এমন স্লোগান নিয়ে ব্র্যাক দিবসটি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট এডুকেশনের নির্বাহী পরিচালক ইরাম মরিয়ম প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের বুদ্ধি, ভাষা, শারীরিক, সামাজিক ও আবেগ–সংক্রান্ত বিকাশ এবং সৃজনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা বাড়াতে খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। পড়ালেখার চাপ ও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের কারণে মা–বাবাও ভুলে যান যে সন্তানের জন্য খেলাটা কতটা জরুরি। খোলা জায়গা পাওয়া না গেলে অন্তত ঘরের ভেতর যেকোনো জিনিস দিয়ে, ছড়া গান, গল্প বলা ইত্যাদির মাধ্যমেও যেন শিশুদের খেলার সময় ও সুযোগ দেওয়া হয়, সে জন্য মা–বাবাকে সচেতন হতে হবে। শুধু মুঠোফোনে খেললে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা হয় না।
জরিপের উপাত্ত তুলে ধরে ইরাম মরিয়ম আরও বলেন, দেশীয় জিনিস দিয়ে খেলতে দিলে শিশুরা বেশি একাত্মবোধ করে। মা–বাবারাও নিজেদের শৈশবে ফিরে যান ও শিশুদের সঙ্গে খেলতে উৎসাহ বোধ করেন। শিশুদের শিক্ষা ও খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি খেলাধুলা তাদের জীবনে যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে, তা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।