রাইডে চড়ে, ছবি তুলে আর প্রেরণাময় কথা শুনে দিন কাটাল কৃতী শিক্ষার্থীরা

ফ্যান্টাসি কিংডমে ঢুকতে লাইনে দাঁড়িয়ে বুথ থেকে হাতের ব্যান্ডসহ প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করছে শিক্ষার্থীরা। আজ ৮ জুলাইছবি: প্রথম আলো

রাইডের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা, রাইডে উঠে চিৎকার করতে করতে মুঠোফোনের ক্যামেরার বাটন চাপা, রাইড থেকে নেমেও একই কাজ। ছবি তোলা আর ছবি তোলা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে এমন একটা মুঠোফোন থাকলে হয়তো তিনি ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’ না লিখে ‘আমার এই ছবি তোলাতেই আনন্দ’ লিখতেন। অন্তত আজ সোমবার যদি তিনি আশুলিয়ার ফ্যান্টাসি কিংডমে থাকতেন, তাহলে তাঁর প্রিয় ‘ওরে কচি’, ‘ওরে কাঁচা’দের ছবি তোলায় মাতোয়ারা হতে দেখে সিদ্ধান্ত বদলে ফেললে অবাক হওয়ার কিছু থাকত না! কারণ, ওদের যত আনন্দ ছিল রাইডে ওঠা আর বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে ঘোরা, তার চেয়ে আনন্দ কম ছিল না জীবনের এই স্মরণীয় দিনটিকে ছবিতে ধরে রাখার। দিনটি কাটিয়েছে তারা ছবি তোলার পাশাপাশি ছোটাছুটি আর গানে গানে।

আজ সকাল থেকে ফ্যান্টাসি কিংডমে শুরু হয়েছে এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। ‘স্বপ্ন দেখো জীবন গড়ো’ স্লোগান নিয়ে প্রথম আলোর আয়োজনে ও শিক্ষার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘শিখো’র পৃষ্ঠপোষকতায় এ আয়োজনে আজ অংশ নিয়েছে ঢাকা, মানিকগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী।

‘শিখো-প্রথম আলো জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতী সংবর্ধনা’ নামে এ উৎসব ঢাকা ও আশপাশের জেলার শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলবে দুই দিন। আজ প্রথম দিনের উৎসবের জন্য নাম নিবন্ধন করেছিল প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী। আগামীকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে নাম নিবন্ধন করেছে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী। এবার সারা দেশের প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী এ উৎসবে অংশ নিতে নাম নিবন্ধন করেছে। গত ২৫ জুন কক্সবাজার জেলার কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে এবারের শিখো-প্রথম আলো জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনার আয়োজন শুরু হয়। শেষ হবে ২৪ জুলাই।

পাওয়ার্ড বাই বিকাশ এবং কনকর্ড গ্রুপ, ফ্রেশ, বহুব্রীহি, সানকুইক, কনকা-গ্রি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসি, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ শাখা ক্যাম্পাস, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, এটিএন বাংলা ও প্রথম আলো বন্ধুসভার সহযোগিতায় এবারের আয়োজন করা হচ্ছে।

এ ছাড়া ফ্যান্টাসি কিংডমে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এখানে তাদের বুথে সার্বক্ষণিক অভিজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স ও সহায়কেরা রয়েছেন। রয়েছে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পরীক্ষার ব্যবস্থা।

বরাবরের মতোই সকাল নয়টা থেকে ফ্যান্টাসি কিংডমের সামনে সারিবদ্ধভাবে তৈরি বুথ থেকে আগেই নাম নিবন্ধন করা শিক্ষার্থীরা তাদের নিবন্ধন নম্বর দেখিয়ে ভেতরে প্রবেশের হাতে বাঁধার ব্যান্ড, রাইডের টিকিট, সনদ, ক্রেস্ট, সকাল ও দুপুরের খাবারের কুপন সংগ্রহ করে পরম উৎসাহে হইচই করতে করতে ভেতরে ঢোকে।

সারিবদ্ধভাবে ফ্যান্টাসি কিংডমে ঢুকছে শিক্ষার্থীরা। আজ ৮ জুলাই
ছবি: প্রথম আলো

আজ দিনের প্রথম ভাগে আবহাওয়া ছিল বেশ মেঘমেদুর। ফ্যান্টাসি কিংডমে ঢুকেই কৃতী শিক্ষার্থীরা রাইডে ওঠা, ছোটাছুটি করা, ছবি তোলায় মেতে ওঠে। মিরপুর থেকে ৩০ জনের বিরাট এক দল এসেছিল উৎসবে। তারা সবাই মিরপুর মডেল একাডেমির শিক্ষার্থী। তাদের নেতৃস্থানীয় তৌফিক নজিব, তানভীর আহমেদ, জুবায়ের আহমেদরা জানাল, সকাল সাতটায় তারা বাড়ি থেকে এসে মিরপুর–১০ নম্বরে সবাই একত্র হয়েছে। তারপর বাসে করে আশুলিয়ায় আসতে তাদের প্রায় তিন ঘণ্টা লেগেছে। এখানে চার লেন সড়ক নির্মাণের কাজ হচ্ছে বলে অনেক সময় লেগেছে। তবে ফ্যান্টাসির ভেতরে ঢুকে ‘পথের ক্লান্তি’ ভুলে গেছে তারা।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনেক অভিভাবকও এসেছিলেন সন্তানের কৃতিত্বের এ উৎসবে। তেমনই এক শিক্ষার্থী আশফি তুনাজ্জিনকে নিয়ে এসেছিলেন মা নাফিসা তুনাজ্জিন। তিনি ভিকারুননিসা নূন স্কুল বসুন্ধরা শাখার ইংরেজির শিক্ষক। মেয়েও একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেইলি রোডের প্রধান শাখা থেকে বিজ্ঞানে জিপিএ-৫ পেয়েছে। মা ও মেয়ে খুবই আনন্দিত উৎসবে অংশ নিয়ে। তাঁরা এসেছিলেন উৎসবে প্রথম আলোর বুথে। এখান থেকে আশফি চলতি মাসের বিজ্ঞানচিন্তা ও কিশোর আলো কিনেছে।

আশফিদের বাড়িতে প্রথম আলো রাখা হয়। তার মা নাফিসা বললেন, প্রথম আলো শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ সংবর্ধনা ছাড়াও গণিত অলিম্পিয়াড, ভাষা প্রতিযোগের মতো যেসব আয়োজন করে, তা শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই উপযোগী। প্রথম আলোর বুথে উৎসবের দুই দিনে ম্যাগাজিনে ১০ টাকা ছাড় দেওয়া হচ্ছে।

অনুষ্ঠান

জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসব মঞ্চের মূল অনুষ্ঠান। প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন ও উপস্থাপক মৌসুমী মৌ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনায় শিক্ষাবিদদের অনুপ্রেরণাময় বক্তব্য, তারকাকথন আর গানে গানে এগিয়ে চলে অনুষ্ঠান। তখন রোদ উঠেছিল প্রখর; কিন্তু কৃতী নবীন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের আনন্দ–উল্লাসে তাতে কোনো সমস্যা হয়নি।

প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের আমন্ত্রণে মঞ্চে এসে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ গণিত অলিম্পিয়াডের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘সমস্যা দেখলে মন খারাপ করবে না। ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাবে। তোমাদের ভালো মানুষ হতে হবে।’

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. মো. আবুল কাশেম মিয়া বলেন, জীবনে লক্ষ্য ঠিক করে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই সাফল্য আসবে।

ফ্যান্টাসি কিংডমে ছবি তুলছে উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা। আজ ৮ জুলাই
ছবি: প্রথম আলো

ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ডিন অধ্যাপক ড. গোলাম আহমেদ ফারুকী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা তারকাদের তারকা, তোমরাই দেশকে এগিয়ে নেবে।’

শিখোর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও শাহীর চৌধুরী বলেন, ‘জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় তোমরা কৃতিত্ব অর্জন করেছ, কিন্তু এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। সামনে আরও বড় লক্ষ্য রয়েছে। সেটি জয় করতে হবে ।’

দিলশাদ নাহার কনা গেয়েছেন বৃষ্টির গান ‘ধিম তানা’ ও ‘দুষ্টু কোকিল ডাকে রে’।

‘তুই কি আমার হবি রে’, ’চলতে চলতে বলতে বলতে’ ও ‘এমন একটা তুমি চাই’—গানে গানে শিক্ষার্থীদের মাতিয়ে তোলেন সংগীতশিল্পী ইমরান মাহমুদুল।

তারকাকথনে নুসরাত ফারিয়া শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘পড়াশোনা ছাড়া জীবনে গতি নেই।’ তিনি প্রত্যেককে তার পাশের মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, ভালো মানুষ হওয়ার আহ্বান জানান।

আফরান নিশো শিক্ষার্থীদের প্রেরণা দিয়ে বলেন, জীবনে সফল হতে হলে পরিশ্রমের বিকল্প নেই। তিনি শিক্ষার্থীদের অনুরোধে তাদের নিয়ে ‘বুক চিনচিন করছে হায়’ গানটির কয়েক লাইনে গলা মেলান।

এভারেস্টজয়ী এম এ মুহিত শিক্ষার্থীদের এভারেস্ট জয়ের কাহিনি শোনান ও অনুপ্রাণিত করেন।

রাইডে চড়ে শিক্ষার্থীদের আনন্দ–উচ্ছ্বাস। আজ ৮ জুলাই
ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের আমন্ত্রণে মঞ্চে এসে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দিয়ে বক্তব্য দেন কনকর্ড গ্রুপের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা অনুপ কুমার সরকার; বিকাশ লিমিটেডের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং হেড অব ব্র্যান্ড ও মার্কেটিং আশরাফ-উল-বারী; মেঘনা গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ড) সাদমান শাহরিয়ার বিশ্বাস; ইলেক্ট্রো মার্ট লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূরুল আফসার।

মাদক, মিথ্যা, মুখস্থ—এই তিন ‘ম’–কে না বলতে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করেন সাজ্জাদ শরিফ ও সুমনা শারমীন।

কৃতী শিক্ষক সংবর্ধনা

এবারের আয়োজনে কৃতী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ঢাকার ১০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০ কৃতী শিক্ষককেও সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এ সংবর্ধনা পর্ব পরিচালনা করেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। এর আগে তিনি শিক্ষার্থীদের নারীদের সম্মান করার অনুপ্রেরণা দেন।

সংবর্ধনা পাওয়া শিক্ষকদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক কবি সাজ্জাদ শরিফ। ১০ শিক্ষক হলেন গবর্নমেন্ট সায়েন্স হাইস্কুলের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক রমজান মাহমুদ; উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের খন্দকার আতিক; বিয়াম মডেল স্কুল ও কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক যাহেদ হোসেন; ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের প্রভাষক মো. শাকিরুল ইসলাম; সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যামিক বিদ্যালয়ের প্রভাষক মো. হুমায়ুন কবির; মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রকাশ কুমার দাস; রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. সুজাউদ্দৌলা; বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ কলেজের প্রভাষক ইকবাল খান; উদয়ন উচ্চমাধ্যামিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রতন কান্তি মণ্ডল; ধানমন্ডি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক রণজিৎ কুমার শীল।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের গানে গানে মাতিয়ে তোলেন ব্যান্ড ওয়ারফেজের শিল্পীরা।

রাইডে শিক্ষার্থীরা। আজ ৮ জুলাই
ছবি: প্রথম আলো

আগামীকালের অনুষ্ঠান

আগামীকাল দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান শুরু হবে সকাল নয়টায়। এতে অতিথি হিসেবে থাকবেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের উপাচার্য ড. ইমরান রহমান, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য ড. কামরুল আহসান। আরও থাকবেন অভিনয়শিল্পী আফজাল হোসেন; সংগীতশিল্পী দিলশাদ নাহার কনা ও প্রীতম হাসান; অভিনেত্রী মাসুমা রহমান নাবিলা। প্রেরণা দেবেন এভারেস্টজয়ী বাবর আলী; শিখোর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী শাহীর চৌধুরী। শেষে থাকবে সোলসের গান।