বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির আহ্বায়ক নাহিদা বুশরা যখন রাস্তায় হাঁটতে যান, তখন তাঁর গা-হাত-পা শিউরে ওঠে। মনে হয়, রাস্তায় তাঁর বন্ধুর রক্ত। তাঁর কান্না পায়। নিজের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তিনি আন্দোলনকারীদের মানসিক অবস্থার কথা তুলে ধরেন। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে তিনি সরকারি ও বেসরকারি—সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
উপকমিটির আরেক সদস্য শামা মাহরীন। আন্দোলনে তিনি নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তিনি বলেন, এখনো ঘুমাতে গেলে তিনি গুলির আওয়াজ পান। বর্তমানে তিনি উপকমিটির প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের দায়িত্বে আছেন।
আন্দোলনে চোখ হারানো রোহান ও ইমরান নামের দুজনের কথা উল্লেখ করে শামা মাহরীন বলেন, ‘ওরা বলে আপু, চোখে দেখতে পারব না কোনো দিন? মাকে দেখতে পারব না, তোমাকেও দেখতে পারছি না।’ শামা মাহরীন বলেন, তাঁদের (ভুক্তভোগী) এই কষ্ট অবর্ণনীয়। তাঁদের মানসিক চাপ বলে বোঝানো যাবে না।
গণঅভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক এক গোলটেবিল বৈঠকে এভাবেই নিজেদের ট্রমার (মানসিক আঘাত) কথা তুলে ধরেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এই দুজন। আজ বৃহস্পতিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসের (বিএপি) আয়োজনে এ বৈঠক হয়।
বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. আবদুল মোত্তালিব। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়টি অবহেলিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানসিক সমস্যা ভোগী মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা না দিয়ে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নেওয়া কঠিন।
গণ–অভ্যুত্থানে আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে বিনা মূল্যে বিশেষ কাউন্সেলিং সেবা এবং আলাদা ওয়ার্ড রয়েছে বলে জানান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মুনতাসীর মারুফ। তিনি বলেন, গ্রামে বা প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য টেলি-সাইকিয়াট্রি ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রসার জরুরি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মানসিক রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. শামসুল আহসান জানান, অভ্যুত্থানে আহত হয়ে বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন থাকা ব্যক্তিদের প্রধান উৎকণ্ঠা হলো চিকিৎসার অনিশ্চয়তা। এ ছাড়া চাকরি, সামাজিক নিরাপত্তা নিয়েও তাঁদের উদ্বেগ আছে।
গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের প্রেসিডেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট মো. রাহেনুল ইসলাম। তিনি মানুষের জরুরি মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেটের দশমিক ১ শতাংশের কম বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, মানুষ মানসিক অসুস্থতার জায়গা থেকে আত্মহত্যা করে। অথচ দেশে আত্মহত্যাকে অপরাধ হিসেবে দেখা যায়। আত্মহত্যাকে অপরাধ হিসেবে না দেখে মানসিক সুস্থতার জন্য সরকারের কাজ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
এবি পার্টির আহ্বায়ক মেজর (অব.) আবদুল ওহাব আন্দোলনে হতাহতদের পাশে দাঁড়াতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে বিএপির সদস্যসচিব অধ্যাপক মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, মানসিক সুস্থতা ও মানবিক সমাজ গঠনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ দরকার।
বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার মো. তৈয়বুর রহমান। এ সময় আরও বক্তব্য দেন জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সংগঠক আলী নাসের খান, ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এ কে এম ওয়ালিউল্লাহ, বিএসএমএমইউর মানসিক রোগ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক সালাহউদ্দিন কাওসার, ছাত্র আন্দোলনকারী রাতুল চৌধুরীসহ প্রমুখ।