যখন লক্ষণ প্রকাশ পায়, ততক্ষণে কিডনির ৬০-৮০ শতাংশ বিকল হয়ে যায়

বিশ্ব কিডনি দিবস উপলক্ষে মিরপুরে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আলোচনা সভায় বক্তারা। ঢাকা, ১৩ মার্চছবি: তানভীর আহাম্মেদ

কিডনি সুস্থ রাখতে হলে সবচেয়ে জরুরি হলো সচেতন থাকা। এই রোগের বিশেষ কোনো প্রাথমিক লক্ষণ থাকে না। যখন লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় ততক্ষণে কিডনির প্রায় ৬০ থেকে ৮০ ভাগই বিকল হয়ে যায়। এ জন্য কিডনির রোগ প্রতিরোধে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনির প্রদাহ ও স্থূলতা বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। তাহলেই এই রোগটি প্রতিরোধ করা যাবে। সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সোসাইটির সভাপতি এ কে আজাদ খান।

আজ বিশ্ব কিডনি দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশন আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক এ কে আজাদ খান এ আহ্বান জানান। দুপুরে মিরপুরে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ। এর আগে কিডনি দিবস উপলক্ষে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আপনার কিডনি কি সুস্থ? দ্রুত শনাক্তকরণ ও কিডনির স্বাস্থ্য সুরক্ষা করুন’।

প্রধান অতিথি অধ্যাপক এ কে আজাদ খান সরাসরি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্যভাবে কিডনি সুস্থ রাখার বিষয়টি জানাতে হবে। এ জন্য স্কুল পর্যায়ে শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, সংস্কৃতিকর্মী এমন বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি ডায়াবেটিক সমিতির অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে ডায়াবেটিস সম্পর্কে মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছেন। তিনি ধূমপান থেকে বিরত থাকার ওপরে জোর দিয়ে বলেন, ধূমপান কেবল কিডনির রোগের ঝুঁকিই বৃদ্ধি করে না, সব ধরনের অসুখেরও অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করে।

বিশ্ব কিডনি দিবস উপলক্ষে মিরপুরে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ঢাকা, ১৩ মার্চ
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সভা শুরু হয়। সূচনা বক্তব্য দেন কিডনি ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচারক টিনী ফেরদৌস রশিদ। তিনি বলেন, কিডনি ফাউন্ডেশন কম খরচে কিডনির রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। এখানে ১ হাজার ৬০০ টাকায় ডায়ালাইসিস করা যায়। ঢাকার বাইরে কিডনির রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য ফাউন্ডেশনের সিরাজগঞ্জ, পাবনার চাটমোহর, সিলেট, রাজশাহী শাখার কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়া পাবনা ও বগুড়া শহরে ফাউন্ডেশনের শাখার কার্যক্রম শিগগিরই শুরু হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন কমিউনিকেবল ডিজিজের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, কিডনির রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে আশার কথা হলো, এই রোগ প্রতিরোধের সুযোগ আছে। রক্ত ও মূত্র পরীক্ষা, রক্তচাপ পরীক্ষার মতো অল্প খরচের পরীক্ষাগুলো নিয়মিত করালে কিডনি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বা প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানা যায়। তখন চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া যায়। তিনি বলেন, এখন দেশের সব জেলায় সরকারি হাসপাতালে অল্প খরচে কিডনির এসব পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। কিডনির রোগের চিকিৎসায় জাতীয় গাইডলাইন তৈরির কাজ চলছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের এপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, হৃদ্‌রোগ, ডায়াবেটিস ও কিডনির রোগ এই তিনটি রোগের অন্যতম প্রধান কারণ প্রায় একই রকম। শরীরে অতিরিক্ত মেদ। কিডনির রোগের চিকিৎসা উন্নত হয়েছে। তবে দেশে কিডনির রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা অপ্রতুল। চিকিৎসাক্ষেত্রে এটা একটা বড় অন্তরায়। তা ছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে কিডনি প্রতিস্থাপনও হয় না। উন্নত দেশে প্রতিস্থাপনের পরিমাণ অনেক বেশি। তিনি বলেন, চিকিৎসার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধের বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। রোগপ্রতিরোধ জীবনযাপনের পদ্ধতির পরিবর্তন আনতে হবে। না হলে রোগাক্রান্তের হার বাড়তেই থাকবে। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যম আরও ভূমিকা রাখতে পারে।

কিডনি ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন তাঁর বক্তব্যে কিডনির রোগ প্রতিরোধে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও শরীরচর্চার প্রয়োজনের ওপরে জোর দেন। তিনি বলেন, অতিরিক্ত লবণ, ফাস্ট ফুড, কোমল পানীয়, চর্বিযুক্ত খাবারের পরিবর্তে ফল, আঁশযুক্ত খাবার ও সবজি বেশি খেতে হবে। প্রাপ্তবয়স্কদের দিনে দুই লিটার বা আট গ্লাস পানি পান করা ও অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি ব্যথানাশক ওষুধ ত্যাগ ও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা যাবে না বলে তিনি সতর্ক করে দেন।

সভাপতির বক্তব্যে ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক হারুন অর রশিদ কিডনি ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম তুলে ধরে বলেন, ২০০২ সালে ধানমন্ডিতে খুবই ছোট আকারে স্বল্প খরচে কিডনির রোগীদের চিকিৎসার মাধ্যমে ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। এখন মিরপুরে এই আটতলা নিজস্ব ভবনে ৩০০ শয্যার হাসপাতাল ও ১০২টি ডায়ালাইসিস যন্ত্র রয়েছে। অল্প খরচে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া ৩০ শতাংশ দরিদ্র রোগীর চিকিৎসা করা হয় বিনা মূল্যে। ইতিমধ্যেই কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছে। ২০১৭ পেয়েছে আইএসএন ‘পাইওনিয়ার অ্যাওয়ার্ড’ এবং গত বছর আইএসএন ‘সেরিয়ার অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে। এখানে সুলভে কিডনির রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি প্রশিক্ষিত নার্স তৈরি করা ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

সভায় কিডনি প্রতিস্থাপন করা রোগী মো. ফিরোজ আলম, সিএপিডি রোগী মো. মাহববু সারওয়ার আলম ও হিমোডায়ালাইসিস রোগী শাহানুর রহমান তাঁদের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। সভা সঞ্চালনা করেন ফাউন্ডেশনের ডা. তাসনুভা সারাহ কাশেম।