বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে যে সহিংস পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন ও চিন রাজ্যে যে সহিংসতা চলছে, তা নিয়ে শঙ্কা আরও বেশি। কারণ, এই সহিংসতা কোথায় গিয়ে থামবে, তা এখনো অজানা। সেই সঙ্গে ভারত ও মিয়ানমারে যে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটছে, তা–ও বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলতে পারে।
‘এক মেরুর বিশ্বব্যবস্থায় ফাটল এবং বহু মেরুর বিশ্বব্যবস্থার উত্থান: ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশের কৌশল’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেছেন। সপ্তম সানেম বার্ষিক অর্থনৈতিক সম্মেলন (এসএইসি) ২০২৪-এর তৃতীয় দিনে আজ রোববার রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টার ইনে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)।
সভায় বক্তাদের কেউ কেউ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন এক মেরুর বিশ্বব্যবস্থা এখনো বহাল রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এক মেরুর বিশ্বব্যবস্থা ভাঙতে শুরু করেছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়—বাংলাদেশের এই পররাষ্ট্রনীতি এখন কাজ করছে না। কেউ কেউ মনে করেন, যে বহু মেরুর বিশ্বব্যবস্থা দেখা দিচ্ছে, তাতে এই পররাষ্ট্রনীতি কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
এই আলোচনা সভার অন্যতম বক্তা সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমাদের পূর্বের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে যা ঘটছে, তা নিয়ে আমি শঙ্কিত। বিশেষ করে মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন রাজ্য নিয়ে আমি বেশি শঙ্কিত। সেখানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আমরা জানি না এটা কোথায় গিয়ে শেষ হবে।’
এ রকম বাস্তবতায় সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়—বাংলাদেশের এই পররাষ্ট্রনীতি এখন কাজ করছে না বলে মনে করছেন এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখনো জানি না, আমাদের কোথায় যেতে হবে।’
মিয়ানমারের নাগরিকদের ফিরিয়ে দিতে বাংলাদেশকেই সমাধান বের করতে হবে বলেও মনে করেন এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারের নাগরিকদের আশ্রয় দিয়েছি, গত সাত বছরে তারা কয়েক গুণ হয়েছে। তারা আরও বাড়বে। আমেরিকা, চীন, ভারত বা অন্যান্য কোনো দেশ নয়, আমাদের নিজেদের এ বিষয়ে সমাধান বের করতে হবে এবং সমাধানে কাজ করতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়; তবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কোথায় যাব।’
এখনো এক মেরুর বিশ্বব্যবস্থা রয়ে গেছে দাবি করে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমরা খুবই ছোট দেশ। তবে এশিয়ার উদীয়মান দুই শক্তিধর দেশ ভারত ও চীনের কাছাকাছি আমাদের অবস্থান, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন এক মেরুর বিশ্বব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের মতো বিষয়গুলো এখন আর কাজ করছে না বলে মনে করেন তিনি। রাষ্ট্রের বাইরেও তালেবান, হামাস, হিজবুল্লাহর মতো তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ কিছু কৌশলগত হুমকিতে রয়েছে বলে মনে করেন হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, প্রতিবেশী দুই দেশ—ভারত ও মিয়ানমারে উগ্র জাতীয়তাবাদ বাড়ছে, যা কেবল ওই দেশগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে অন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
হুমায়ুন কবির বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট ছাড়াও মিয়ানমারের এই উগ্র জাতীয়তাবাদ আমাদের ওপর মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। একইভাবে ভারতের উগ্র জাতীয়তাবাদ আমাদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এসব বিষয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে।’
যে বহু মেরুর বিশ্বব্যবস্থার উদয় ঘটছে, তাতে টিকে থাকতে হলে কৃষির মতো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যে অর্থনৈতিক শক্তি রয়েছে, তার আরও যত্ন নিতে হবে বলেও মনে করেন হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, তাহলেই কেবল এই কঠিন পরিস্থিতি বাংলাদেশ মোকাবিলা করতে পারবে।
বাংলাদেশের যে পররাষ্ট্রনীতি, তা বহু মেরুর বিশ্বব্যবস্থায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। আলোচনা সভায় তিনি বলেন, এই নীতি যে ভালো কাজ করে, তা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দেখা গেছে। সেখানে একটি পক্ষ সবকিছু নির্ধারণ করে দেয়নি। অন্য পক্ষগুলোও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
বহু মেরুর বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশকে দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, প্রথমত, বাংলাদেশকে পেশাদার হতে হবে। বহু মেরুর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হলে কেবল ইংরেজি জানলেই হবে না। ফরাসি, হিন্দি, চায়নিজ, জাপানিজ, রুশ—অন্যান্য ভাষাও জানতে হবে। তাহলেই কেবল জানা যাবে গোড়ায় কী ঘটছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের ধনীদের দুই পা-ই বাংলাদেশে রাখতে হবে। কারণ, ধনীদের এক পা বিদেশে। এটা গুরুতর সমস্যা। তাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে, তারা ফিরবে না দেশে। এটা কেবল মেধা পাচার নয়, সম্পদও এতে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমারকে নিয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করা উচিত বলে মনে করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি মনে করেন, এ জন্য ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ত হওয়া উচিত আরও বড় পরিসরে।
এই আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন।