সাফারি পার্কের বাহারি প্রাণী
ছেলেমেয়েকে নিয়ে সপরিবারে ভরদুপুরে খেতে বসেছেন। এমন সময় উঁকি দিল বড়সড় ডোরাকাটা বাঘ। কী হবে এবার? খাবার কি আর গলা দিয়ে নামবে? মনে হবে, আমরাই না বাঘের খাবার হয়ে যাই! কিন্তু এখানে দৃশ্যপট অন্য রকম। বাঘ দেখলেই খাবার ফেলে ছুট দেয় সবাই। আনন্দে শিশুরা হাততালি দেয়। হুড়োহুড়ি করে মুঠোফোনে বাঘের ছবি তোলা হয়।
এত সাহসের কারণ কী? একটি কাচের বেষ্টনী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের টাইগার রেস্টুরেন্টে কাচের বেষ্টনীর ওপারে দেখা মেলে বাঘেদের। শুধু বাঘ নয়, সিংহ, কুমির, হরিণ, হাতি, জলহস্তী, ভালুক, হনুমান, বানর, জেব্রা-জিরাফ, ময়ূর-কাকাতুয়া, ক্যাঙারু, আরও কত-কী! গাজীপুরের এই সাফারি পার্কে এক চক্কর দিলে দেখা মিলবে হাজারো বন্য পশুপাখি ও মাছের। দেখে মনে হবে যেন ওরা বনের মধ্যে বা আপন ভুবনেই আছে। বাংলাদেশে কয়েক বছর আগেও এমনটি কল্পনা করা যেত না।
এখানকার বিশাল প্রাণিজগৎ কেবল রেস্টুরেন্টে বসে নয়, আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ মিলবে। এ জন্য বাসে চড়ে যেতে হবে টাইগার সাফারি, লায়ন সাফারি, আফ্রিকান সাফারি। চিড়িয়াখানা থেকে গাঁটের পয়সা হয়তো কিছুটা বেশি খরচ হবে। কিন্তু আনন্দ মিলবে কয়েক গুণ। এই আনন্দের ধরন আর বৈচিত্র্যও অন্য রকম।
বাসে বসে প্রায় এক ঘণ্টায় একেবারে কাছ থেকে দেখা যাবে সিংহ তার বাচ্চা নিয়ে পথের ধারে বসে আছে। বনের মতো গড়া এখানকার ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে আসছে বাঘ। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বেঙ্গল টাইগাররা। পাশের ডিয়ার সাফারিতে হরিণেরা সব দল বেঁধে ছুটোছুটি করছে। আগন্তুক কাউকে দেখলে দাঁড়িয়ে থাকছে চিত্রা আর মায়া হরিণেরা। একটু এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে শুকনো গাছের শক্ত ডালে বসে আছে কালো ভালুক।
আফ্রিকান সাফারির বাসিন্দা ব্লেস বক, জেব্রা-জিরাফ, অরিক্স, কমন ইলান, ওয়াইল্ড বিস্ট থাকে চুপচাপ। আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে ওদের কাছে গেলেও সরে যায় না। গতকাল বুধবার আফ্রিকান সাফারিতে গেলে হরিণের মতো দেখতে ব্লেম বক নামের প্রাণীটি প্রথমেই স্বাগত জানাল। খানিক এগিয়ে গেলে উঁচু একটি জায়গায় একসঙ্গে পাওয়া গেল জেব্রা আর জিরাফকে। তিনটি জেব্রার সঙ্গে তিনটি জিরাফের সে কী ভাব! একটু সামনে গিয়ে দেখা গেল আরেকটি জিরাফ গাছের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে। অতিথি দেখে একটুও বিচলিত নয় সে। ওদিকে ওয়াইল্ড বিস্ট, কমন ইলান আর অরিক্সরা ছুটোছুটি করতে লাগল। আলাদা করে চোখে পড়ল সিংহের দাপট। এর একটু আলাদা বর্ণনা দিই।
সিংহের দাপট
সাতটি সিংহকে প্রথম একটি বেষ্টনী রাখা হয়েছে। গতকাল সেখানে যেতেই ওদের হাঁকডাক শুরু হলো। পাশের বেষ্টনীর পাঁচটি সিংহশাবকের তেজ কিছুটা বেশি। কারণ, সেখান থেকে কাউকে দেখা যায় না। মানুষের গন্ধ পেলে ওদের তেজি ভাব বেড়ে যায়। মায়ের সঙ্গে ঘুরে-ফিরে দেখা করে যায়। শাবক হলে কী হবে! মানুষ দেখলে সিংহশাবকদের তেজ আরও বেড়ে যায়। কচি কণ্ঠে শুরু করে তর্জন-গর্জন।
২০১৩ সালে উদ্বোধনের পর সাফারি পার্কে নয়টি সিংহ ছিল। এর মধ্যে দুটি মারা যায়। বাকি সাতটির মধ্যে পাঁচটি আফ্রিকার। নাসরিন ও জেরিন নামের দুটি সিংহীকে কক্সবাজারের ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক থেকে আনা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের ওয়াইল্ড লাইফ সুপারভাইজার মো. সরওয়ার হোসেন খান জানান, নাসরিন ২০১৫ সালের ১৭ ও ১৮ জুন দুটি বাচ্চা জন্ম দেয়। জেরিন এ বছর মা হতে যাচ্ছে। তবে সাফারি পার্কে অন্য সিংহরাও দাপটে রয়েছে। এখানে ১৪টি সিংহের বাচ্চা জন্ম নিয়েছে। দুটি শাবক ওর মায়ের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাকি ১২টি শাবক খাঁচায় রয়েছে। এখানেই ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব হবে। এসব সিংহের বয়স ছয় মাস থেকে দেড় বছর বয়স। এরই মধ্যে বেশ সখ্য হয়েছে। বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হলে ওদের ছেড়ে দেওয়া হবে। সব মিলে ২১টি সিংহ লায়ন সাফারিতে একসঙ্গে দেখা যাবে।
বাংলার বাঘের খুনসুটি
সিংহদের ভাব রয়েছে। তবে বাংলার বাঘ বা বেঙ্গল টাইগারের খুনসুটি লেগেই আছে। সুযোগ পেলেই বেধে যায় সংঘর্ষ। বাঘদের মধ্যে দলাদলিও রয়েছে। একদল আরেক দলকে সহ্যই করতে পারে না। মূলত বাঘিনীকে নিয়েই এমন ঝগড়া হয় বলে জানালেন দেখভালকারীরা।
তত্ত্বাবধানকারীরা বলেন, একটি দলে দুটি নারী ও একটি পুরুষ বাঘ থাকে। এ রকম দুটি দলকে আলাদা আলাদা করে বেষ্টনী মধ্যে রাখা হয়। আরেকটি দলকে টাইগার সাফারিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এদের সংঘর্ষ এড়াতে একটি দলকে বাইরে রাখলে দুটি দল গৃহবন্দী থাকে। কয়েক দিন আগে দুটি বাঘ মারামারি করে আহত হয়েছে। ওদের চিকিৎসা চলছে বলে জানা গেছে। বেষ্টনীর মধ্যে শুয়ে ঘুমিয়ে একটি বাঘকে দিন কাটাতে দেখা গেছে। এর পাশের বেষ্টনীতে একটি পুরুষ বাঘের সঙ্গে দুটি নারী বাঘের দলকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। পাশের আরেকটিতে তিনটি নারী বাঘকে আলাদা করা হয়েছে। একটি পুরুষ ও একটি নারী বাঘকে টাইগার সাফারিতে ছেড়ে রাখা হয়েছে।
সাফারি পার্কে বাঘের তত্ত্বাবধায়ক মো. হাসান বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে ১০টি বাংলার বাঘ বা বেঙ্গল টাইগার রয়েছে। এদের মধ্যে নয়টি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনা। এর মধ্যে তিনটি বাঘ ও ছয়টি বাঘিনী। আফ্রিকান বাঘগুলোর আবদ্ধ পরিবেশে জন্ম। অন্য নারী বাঘটি সুন্দরবন থেকে আনা। সাতক্ষীরায় ২০১২ সালে শিকারিদের ফাঁদে পড়ে এই বাঘটি তার ডান পা হারিয়েছিল। সেখান থেকে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে রাখা হয়। ২০১৩ সালের শেষের দিকে গাজীপুরের এই সাফারি পার্কে আনা হয়। তবে সুন্দরবনের বাঘিনীর সঙ্গে আফ্রিকার বাঘগুলোর সখ্য নেই। আকারে ছোট হলেও সুন্দরবনের বাঘিনীর সামনে আফ্রিকার থেকে আনা বেঙ্গল টাইগারগুলো অনেকটা অসহায় হয়ে যায়। তাই সুন্দরবনের বাঘিনীকে একেবারেই আলাদা করে রাখা হয়েছে।
ময়ূরের রাজ্য
বাঘ-সিংহের মতো অতটা না হলেও ময়ূর-ম্যাকাওয়ের কদর আছে বেশ। ময়ূরের ছাউনিতে ওদের বেশ সখ্য। ওখানে একসঙ্গে মিলবে প্রায় ১০০ ময়ূর। সাফারি পার্কে তিন বছরে প্রায় ৫০টি ময়ূরের জন্ম হয়েছে। সেখানে গেলে মনে হবে, এ যেন এক ময়ূররাজ্য। কেউ পেখম মেলেছে। কেউ মাটিতে নেমে খাবার খুঁজছে। কোনো কোনো ময়ূর আবার শেডের ভেতর গাছের ডালে বসে ডাকাডাকি করছে।
ওয়াইল্ড লাইফ সুপারভাইজার সরওয়ার হোসেন খান বলেন, ভারতীয় ময়ূর ৮৫টি, সাদা ময়ূর দুটি ও এদের তিনটি বাচ্চা, গোল্ডেন ফিজেন্ট তিনটি ও সিলভার ফিজেন্ট ৫টি। সব মিলিয়ে ৯৮টি ময়ূর রয়েছে।
গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের সুপারভাইজার মো. সরওয়ার হোসেন খান জানান, পৌনে চার হাজার একর আয়তনের এই পার্কে ৪৭ প্রজাতির প্রায় তিন হাজার পশুপাখি রয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি দেশি প্রজাতির বন্য প্রাণী রয়েছে। এর বাইরে কচ্ছপও রয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি। এই জলাধারে মাছ রয়েছে হরেক রকমের। একজন দর্শনার্থী একবার ঘুরলে প্রকৃতির মাঝে বিচিত্র পশুপাখির দেখা পাবেন।