২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহার বুকে-পিঠে ছিল জখমের দাগ

সিনহা রাশেদ। ফাইল ছবি
সিনহা রাশেদ। ফাইল ছবি

৩১ জুলাই, রাত ৯টা। টেকনাফ থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে নিজস্ব প্রাইভেট কারে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান (৩৬)। সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন সিফাত নামের আরেকজন। ৮৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কটির পশ্চিম পাশে উত্তাল বঙ্গোপসাগর, আর পূর্ব পাশে উঁচু সবুজ গাছপালার পাহাড়সারি। সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মিত দৃষ্টিনন্দন মেরিন ড্রাইভ সড়কটি আগে পর্যটকদের ভ্রমণে উৎকৃষ্ট স্থান হলেও এখন আতঙ্কের এলাকায় পরিণত হয়েছে। এ সড়কে বন্দুকযুদ্ধে মানুষের মৃত্যুর সারি লম্বা হতে থাকায় সন্ধ্যার পর কেউ মেরিন ড্রাইভে উঠতে ভয় পান। সন্ধ্যা থেকে ভোররাত পর্যন্ত সড়কটি ফাঁকাই পড়ে থাকে।

মেজর (অব.) সিনহার গাড়িটি প্রথমে বিজিবির একটি চেকপোস্ট এসে থামে। পরিচয় পাওয়ার পর বিজিবি সদস্যরা তাঁদের ছেড়ে দেন। এরপর রাত ৯টার দিকে সিনহার গাড়িটি এসে পৌঁছায় দ্বিতীয় চেকপোস্ট টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে। পুলিশের নির্দেশনা পেয়ে গাড়ি থেকে প্রথমে হাত উঁচু করে নামলেন সিফাত। এরপর নিজের পরিচয় দিয়ে হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামলেন মেজর (অব.) সিনহা। সিফাতের ভাষ্য, কোনোরূপ জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই মেজর (অব.) সিনহার বুকে একে একে তিনটি গুলি ছোড়েন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী। মুহূর্তেই তিনি মাটিতে ঢলে পড়েন। সিনহার ব্যক্তিগত পিস্তল থাকলেও সেটি গাড়িতে ছিল। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে এমন বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

তবে পুলিশের ভাষ্য অন্য রকম। পুলিশ বলছে, চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি থামিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা বাধা দেন। এই নিয়ে তর্কবিতর্কের একপর্যায়ে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা তাঁর কাছে থাকা পিস্তল বের করলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা গুরুতর আহত হন। তাঁকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পর সিনহা যে গেস্টহাউসে উঠেছিলেন সেই গেস্টহাউসে সিনহার কক্ষে তল্লাশি করে পুলিশ। পুলিশের দাবি, সেখান থেকে বিদেশি মদ ও গাঁজা উদ্ধার করা হয়।

ঘটনার পর কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, শামলাপুরের লোকজন ওই গাড়ির আরোহীদের ডাকাত সন্দেহ করে পুলিশকে খবর দেন। এই সময়ে তল্লাশি চেকপোস্টে গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু গাড়ির আরোহী একজন তাঁর পিস্তল বের করে পুলিশকে গুলি করার চেষ্টা করেন। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ওই ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তার মৃত্যু হয়েছিল। শনিবার সকালে তাঁর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। শাহীন মো. আবদুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তার বুকে ও পিঠে জখমের দাগ আছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে এলে বলা যাবে জখমের চিহ্ন গুলির কি না।

সিনহার শরীরের ওপরের অংশ কর্দমাক্ত এবং বুক ও গলা গুলিবিদ্ধ ছিল। হাতে হাতকড়া লাগানোর দাগ ছিল বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে।

নিহত সেনা কর্মকর্তা সিনহার বাড়ি যশোরের বীর হেমায়েত সড়কে। তাঁর বাবা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব মুক্তিযোদ্ধা মরহুম এরশাদ খান। সিনহা ৫১ বিএমএ লং কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশন লাভ করেন। ২০১৮ সালে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সেও (এসএসএফ) দায়িত্ব পালন করেন।

শুটিং করতে কক্সবাজারে গিয়েছিলেন সিনহা রাশেদ

৩ জুলাই ঢাকা থেকে কক্সবাজার আসেন মেজর (অব.) সিনহা। উদ্দেশ্য, ‘জাস্ট গো’ নামে ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ট্রাভেল ভিডিও নির্মাণ। সঙ্গে ছিলেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের তিনজনসহ মোট চারজন। ওঠেন মেরিন ড্রাইভ সড়কের হিমছড়ি ঝরনা এলাকার নীলিমা রিসোর্টে।

প্রায় এক মাস তাঁরা কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে শুটিং সম্পন্ন করেন। ৩১ জুলাই বিকেলে সঙ্গী সিফাতকে নিয়ে মেজর (অব.) সিনহা কক্সবাজার থেকে টেকনাফের শামলাপুর পাহাড়ে যান। এ সময় সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার পরনে ছিল সামরিক পোশাক (কম্ব্যাট টি-শার্ট, কম্ব্যাট ট্রাউজার ও ডেজার্ট বুট)।

সন্ধ্যা ও রাত্রিকালীন শুটিং শেষ করে তাঁরা রাত সাড়ে আটটার দিকে পাহাড় থেকে নেমে আসার সময় স্থানীয় কয়েকজন লোক ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার দেন এবং শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেন।

পাহাড় থেকে নেমে মেজর (অব.) সিনহা সিফাতকে নিয়ে নিজস্ব প্রাইভেট কারে ওঠেন। রাত ৯টার দিকে তাঁরা পৌঁছান শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে। সেখানে আগে থেকেই ডাকাত প্রতিরোধে প্রস্তুত ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ পুলিশের সদস্যরা। পুলিশের সংকেত পেয়ে মেজর (অব.) সিনহা গাড়ি থামান এবং নিজের পরিচয় দিলে প্রথমে তাঁদের চলে যাওয়ার সংকেত দেওয়া হয়। পরে পরিদর্শক লিয়াকত আলী তাঁদের পুনরায় থামান এবং তাঁদের দিকে পিস্তল তাক করে গাড়ি থেকে নামতে বলেন। সিফাত হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির পেছনের দিকে গিয়ে দাঁড়ান। মেজর (অব.) সিনহা গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নামার পরপরই পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত তাঁকে তিনটি গুলি করেন। গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে ঘটনার এভাবে বর্ণনা করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গুলি করার পরপরই রাত পৌনে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন স্থানীয় জনগণ ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাঠকর্মী সার্জন আইয়ূব আলী। তখন গুলিবিদ্ধ সেনা কর্মকর্তাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পান তাঁরা। সার্জন আলী ঘটনার ভিডিও রেকর্ড করতে চাইলে পুলিশ সার্জনের পরিচয় জানতে চায়। পরিচয় দেওয়ার পর পুলিশ সার্জনের হাত থেকে মুঠোফোন সেট ও তাঁর পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাত ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে আনা হয় একটি মিনিট্রাক। ট্রাকে ওঠানোর সময়ও মেজর সিনহা জীবিত ছিলেন এবং নড়াচড়া করছিলেন। এরপর সিনহাকে নিয়ে ট্রাকটি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পৌঁছায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর। তখন হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক সিনহাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতাল থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব ১ ঘণ্টার পথ। অতিরিক্ত ৪৫ মিনিট অতিবাহিত করা পুলিশের একটি অপকৌশল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে পুলিশ জানিয়েছে, ওই সাবেক সেনা কর্মকর্তা তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে করে অপর একজন সঙ্গীসহ টেকনাফ থেকে কক্সবাজারের দিয়ে যাচ্ছিলেন। মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া তল্লাশি চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি থামিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা বাধা দেন। এই নিয়ে তর্কবিতর্কের একপর্যায়ে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা তাঁর কাছে থাকা পিস্তল বের করলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা গুরুতর আহত হন। তাঁকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, এই ঘটনায় টেকনাফ থানায় দুটি মামলা হয়েছে। সেনা কর্মকর্তার সঙ্গী সিফাতসহ দুজনকে আটক করা হয়েছে। ওই ঘটনায় টেকনাফ থানায় অস্ত্র ও মাদক আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ সিনহার গাড়ি ও নীলিমা রিসোর্ট তল্লাশি করে জার্মানিতে তৈরি একটি পিস্তল, নয়টি গুলি, ৫০টি ইয়াবা, দুটি বিদেশি মদের বোতল এবং চার পোটলা গাঁজা উদ্ধার করেছে। গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনেও নীলিমা রিসোর্টে অবস্থানরত দুজনের কেবিন তল্লাশি করে পুলিশ দেশি-বিদেশি মদ ও গাজা উদ্ধারের কথা উল্লেখ আছে।

হিমছড়ি ঝরনা স্পট থেকে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে মারমেইড বিচ রিসোর্টের কাছে নীলিমা রিসোর্ট। সাইক্লোন শেল্টার আদলে ( নিচে পার্কিং, ওপরের তলায় থাকার কক্ষ) একতলা ১০টি রিসোর্ট রয়েছে সেখানে। একটি রিসোর্টে থাকতেন সিনহাসহ চার জন। রিসোর্টের ব্যবস্থাপক মো. সোলাইমান মনজুর প্রথম আলোকে বলেন, দুই মাসের জন্য রিসোর্টটি ভাড়া নিয়েছিলেন মেজর (অব) সিনহা। আলাদা আলাদা কক্ষে থাকতেন চারজন। ৩১ জুলাই বিকালে সিনহা ও সিফাত প্রাইভেট কার নিয়ে টেকনাফ শ্যুটিং চলে যান। রিসোর্টে ছিলেন দুইজন। সোলাইমান মনজুর বলেন, রাত দুইটার দিকে রিসোর্টের একজন কর্মচারী তাঁকে ( মনজুরকে) মুফোঠোনে জানান যে, রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ সিনহার রিসোর্টে অভিযান চালিয়ে কিছু মদের বোতল ও গাজা উদ্ধার করেছে। এ সময় এক জনকে (তরুণকে) ধরে নিয়ে যায় পুলিশ । কিন্তু গাজা ও মদের বোতলের পরিমাণ কত ছিল কর্মচারীরা তাঁকে জানাতে পারেননি। ওই সময় তিনিও রিসোর্টের বাইরে বাসায় ঘুমাচ্ছিলেন।

এদিকে আজ সোমবার সকালে শামলাপুর চেকপোস্টে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে পাঁচজন পুলিশ কনস্টেবল বসে আছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক সদস্য বলেন, তাঁরা কক্সবাজার থেকে নতুন এসেছেন, ঘটনা সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানেন না।

শামলাপুর বাজারে সেনা কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ড নিয়ে লোকজন আলোচনা করলেও কেন হত্যাকাণ্ড, সেই কারণ জানাতে পারছেন না।

জাফর আলম নামের স্থানীয় এক জেলে বলেন, গত এক বছরে মেরিন ড্রাইভে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে অন্তত ২০০ লোক মারা গেছেন। কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। এখন সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা মারা যাওয়ার পর তোলপাড় চলছে। সাদাপোশাকধারী বিভিন্ন সংস্থার লোকজন এলাকায় এসে ঘটনার তত্ত্ব-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন। কিন্তু ক্রসফায়ার আতঙ্কে মানুষ মুখ খুলছেন না।

২০১৮ সালের ৪ মে থেকে সারা দেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়। গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের সঙ্গে একাধিক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৮৭ জন। এর মধ্যে পুলিশের সঙ্গে ১৭৪ জন, বিজিবি সঙ্গে ৬২ জন ও র‌্যাবের সঙ্গে ৫১ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ১৬১ জন।

পুলিশের দাবি, নিহত লোকজনের অধিকাংশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী।