ধার না দেওয়ায় প্রবাসী নারীকে কুপিয়ে হত্যা, আদালতে জবানবন্দি
সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলায় যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী নারীর কাছে কিছু টাকা ধার চেয়েছিলেন এক ব্যক্তি। কিন্তু তিনি তাঁকে টাকা না দিয়ে উল্টো ভর্ৎসনা করেছিলেন। এতে ক্ষোভে ও অপমানে তিনি তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করেন। ওই প্রবাসী নারীকে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওই ব্যক্তি তাঁকে হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন। আজ রোববার সিলেটের একটি আদালতে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার নাগরিকাপন গ্রামে প্রায় ৩৫ শতক জায়গায় অত্যাধুনিক দোতলা বড় বাড়ি। বাইরে থেকে ফটক তালাবদ্ধ। বাড়ির দরজা দুটোতেও ঝুলছিল তালা। এ বাড়িতে একা বসবাস করতেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ওই নারী। দুদিন তাঁর ব্যবহৃত মুঠোফোন বন্ধ পাওয়ায় আত্মীয়রা খোঁজাখুঁজি করে ব্যর্থ হলে পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ তালা ভেঙে ঘরের একটি কক্ষে তাঁর লাশ পায়। লাশের গায়ে এলোপাতাড়িভাবে দায়ের কোপের চিহ্ন ছিল। লাশ উদ্ধারের এ ঘটনা গত বুধবার বিকেলের। নিহত ওই নারীর নাম রহিমা বেগম (৬০)। যুক্তরাজ্যে তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। রহিমা নিজেও যুক্তরাজ্যের নাগরিক। সন্তানদের সঙ্গে সেখানেই বসবাস করতেন তিনিও। পবিত্র হজব্রত পালন করার পর তিনি প্রায় এক বছর ধরে সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার নাগরিকাপন গ্রামের বাড়িতে একা বসবাস করছিলেন।
প্রবাসী রহিমা বেগমকে নিভৃত জীবন যাপন করা অবস্থায় কে, কী কারণে হত্যা করেছে, তা জানার জন্য পুলিশ ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। বাড়ির মূল্যবান আসবাব কিছুই খোয়া যায়নি। এমনকি রহিমা বেগমের শরীরের স্বর্ণালংকারও অবিকল ছিল। শুধু মুঠোফোনটি পাওয়া যায়নি। এই মুঠোফোনের সূত্র ধরে অবশেষে সম্ভাব্য খুনিকে খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি ওসমানীনগর উপজেলার নাগরিকাপন গ্রামের আবদুল জলিল ওরফে কালু (৪০)। ঈদের দিন অর্থাৎ গতকাল শনিবার দিবাগত মধ্যরাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। আজ রোববার আদালতে ১৬৪ ধরায় জবানবন্দি দেন তিনি।
জলিলের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, গত মঙ্গলবার (২৮ জুলাই) বিকেলে ওই বাড়িতে গিয়ে রহিমার কাছে ঈদ উপলক্ষে পাঁচ হাজার টাকা ধার চান জলিল। রহিমা বেগম তাঁর পরিচয় ও পেশা জানতে চান। জলিল কিছু করেন না বলে জানালে রহিমা শ্লেষের সঙ্গে ‘বইতল’ বলে তাঁকে ভর্ৎসনা করেন। কিছুক্ষণ পর জলিল ওই বাড়িতে ঢুকে রহিমার মাথায় একটি বাঁশের টুকরা দিয়ে আঘাত করেন। এরপর রান্নাঘর থেকে বঁটি নিয়ে এসে উপর্যুপরি কোপ দেন। রহিমাকে নৃশংস কায়দায় হত্যা করে লাশটি ওয়াশরুমের কাছে ফেলে রাখেন জলিল। পরে বঁটি ধুয়ে আবার রান্নাঘরে রেখে দেন। ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা দামি মুঠোফোনটি নিয়ে জলিল ঘর থেকে তিনটি তালা ও চাবি নিয়ে দুটো তালা ঘরের মূল দরজায় ও আরেকটি তালা ফটকে মেরে চলে যান।
ওসমানীনগর থানা-পুলিশ সূত্র জানায়, ওই দিন রহিমা বেগমকে ফোনে না পেয়ে যুক্তরাজ্য থেকে তাঁর ছেলেরা যোগাযোগ করেন সিলেট শহরের শামীমাবাদ আবাসিক এলাকার আত্মীয়দের সঙ্গে। এরপর ওসমানীনগরে থাকা আরও আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরদিন কয়েকজন আত্মীয় বাড়িতে গিয়ে তা তালাবদ্ধ দেখে ওসামানীগর থানা-পুলিশে খবর দেন। বুধবার বিকেলে বাড়ির তালা ভেঙে পুলিশ রহিমা বেগমের লাশ পায়।
পুলিশের প্রাথমিক ধারণা ছিল, অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা লুটপাট করতে গিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটাতে পারে। কিন্তু বাড়ির মূল্যবান সব আসবাব এমনকি রহিমা বেগমের পরনে থাকা স্বর্ণালংকারও অবিকল থাকায় পুলিশ খুনের অন্য কারণ খুঁজতে থাকে। এরপর বাড়ির একমাত্র গৃহকর্মীসহ ১০ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই তালিকার সর্বশেষ ব্যক্তি ছিলেন আবদুল জলিল ওরফে কালু।
রহিমা বেগমের বাড়িতে স্থানীয় এক কিশোরী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত। মেয়েটি বিকেলে এসে কাজ সেরে রাতে চলে যেত। মেয়েটির বাবাও প্রয়োজন পড়লেই রহিমা বেগমের বাজার করে দিতেন। আবদুল জলিল ওরফে কালু নাম-পরিচয় না প্রকাশ করে অজানা একটি মুঠোফোন নম্বর থেকে পুলিশকে জানান, ওই গৃহকর্মী ও তার বাবার কাছে রহিমা বেগমের খোয়া যাওয়া মুঠোফোন থাকতে পারে এবং তাঁরা দুজন এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে। এরপরই গৃহকর্মী কিশোরী ও তার বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। সঙ্গে অজ্ঞাত ফোনকারীকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে ও তাঁর নাম-পরিচয় শনাক্ত করে।
পুলিশ সূত্র জানায়, স্বেচ্ছায় তথ্য দেওয়ায় সন্দেহভাজন ১০ জনের তালিকায় থাকা ১০ নম্বর ব্যক্তি জলিলকে মূল সন্দেহভাজন চিহ্নিত করা হয়। তাঁর সম্পর্কে তথ্য নিতে গিয়ে দেখা যায়, ২০০৭ সালে অপর একটি হত্যা মামলার আসামি তিনি। গতকাল দিবাগত রাত তিনটার দিকে নাগরিকাপন গ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে জলিলকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একপর্যায়ে তিনি রহিমা বেগমকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। পরে রহিমার মুঠোফোনটি তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়।
জেলা পুলিশ আজ রোববার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, একটানা ২০ ঘণ্টা চলা অভিযানে খুনিকে শনাক্ত ও খুনের কারণ উদঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মো. মাহবুবুল আলমের তত্ত্বাবধানে ওসমানীনগর ও বিশ্বনাথ সার্কেল পুলিশের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম এ অভিযানে নেতৃত্ব দেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধার চাওয়া টাকার চেয়ে “বইতল” ভর্ৎসনায় জলিল বেশি ক্ষুব্ধ হন। “বইতল” সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় চূড়ান্ত মাত্রার অপমানসূচক ভর্ৎসনা হিসেবে প্রচলিত। অভিযানকালে জলিল আগ বাড়িয়ে গৃহকর্মী ও তাঁর বাবা জড়িত বলে জানিয়েছিলেন। এ কারণে তাঁকে আমরা সন্দেহভাজনের তালিকার শীর্ষে নিয়ে আসি। তাঁকে আটকের পর তিনি খুনের কারণ বর্ণনা দেন। পুলিশে দেওয়া বর্ণনাগুলো পরবর্তী সময়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।’
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর ও মিডিয়া) মো. লুৎফুর রহমান জানান, দেশে বসবাসকারী রহিমা বেগমের ছোট ভাই আবদুল কাদির বাদী হয়ে এ ঘটনায় ওসমানীনগর থানায় হত্যা মামলা করেছেন। এ মামলায় জলিলকে একমাত্র আসামি করা হয়েছে। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।